বর্ণবাদ বা জাতপ্রথা

ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তের একটি মন্ত্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের সংবাদ প্রথম দিয়েছে। এই মন্ত্র আরোও জানিয়েছে যে এক ঈশ্বর থেকে চার বর্ণের মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। সেসব স্থান থেকে বর্ণগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো হলো, মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পদযুগল থেকে শূদ্র। উৎপত্তিস্থল অনুসারে পর্যালোচনা করলে বর্ণবাদের তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে ওঠবে। যেমন : ব্রহ্মার মুখ থেকে  জন্মেছে ব্রাহ্মণ বলে তাদের প্রধান কাজ হল মন্ত্রোউচ্চারণ, ঈশ্বরের গুণগান, সৎ উপদেশ দেওয়া। বাহু হলো বলের প্রতীক। যেসব ব্যক্তি বাহুবলের উপর নির্ভর করে ভয়ভীতি তুচ্ছ গণ্য করে অপরের উপকার ও অপরকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেন, তারাই ক্ষত্রিয়। উরু পুষ্টির প্রতীক, কর্মের প্রতীক। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি কর্ম, পশুপালন এসব করে যারা সমাজকে রক্ষা ও প্রতিপালন করবে তারাই বৈশ্য।পদযুগল হল শ্রমের প্রতীতুচ্ছ। যারা সমাজকে বাঁচিয়ে রাখবে তারাই শূদ্র।গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন,  "চার্তুবর্ণ্য ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম বিভাগশঃ "। এভাবে ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী হতে বর্ণভেদ প্রথার সূচনা হয়। মনুসংহিতার এই চার বর্ণের মানুষের কাজের ক্ষেত্র সমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের দ্বারা সৃষ্টি আরম্ব হয়েছিল।সে গুণের তারতম্যের জন্যই মানুষের মূল্যবোধের তারতম্য বিবেচনা করা হয়েছে।

কিছু সংখ্যক মানুষ জন্মগতভাবে ভালো অবস্থানে না থাকলেও তাদের নিজস্ব জ্ঞান, ধীশক্তি ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনেক সদ্গুণাবলি অর্জন করে। তার ফলে সমাজে শ্রদ্ধার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বর্ণপ্রথা তখন তাদেরকে উন্নত স্থানে অবস্থান করতে সাহায্য করে।

বৈদিক যুগে বিভিন্ন জাতির উল্লেখ থাকলেও তাদের মধ্যে বর্ণগত ভেদাভেদ ছিল না। জাতিভেদ প্রথার ব্যাপক প্রবর্তন শুরু হয় ভৌগলিক অবস্থান, আচার-ব্যবহারের পরিবর্তনের ফলে। মূলতঃ আধুনিক পৃথিবীতেও এ জাতীয় ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।

এই বর্ণ প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষে বর্তমানে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন ধর্মের সাথে সম্পর্কহীন সামাজিক প্রয়োজনে সৃষ্টি এই বর্ণপ্রথা বিলোপ হতে বাধ্য। প্রাচীর গ্রন্থাবলি মূলতঃ বর্ণবিভাগকে ধর্মের নির্দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে না। বাস্তবে বর্তমানে বর্ণ বিভাগ যেভাবে বিরাজমান তা আত্মার সাথে সম্পর্কযুক্ত হিন্দু ধর্মের সর্বব্যাপী ব্রহ্মের মৌলিক মতবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী।

মহাভারতে একটি স্রোতে উল্লেখ আছে যে, ভৃগু মুনি বর্ণ প্রথা সম্পর্কে ভরদ্বাজকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, ব্রাহ্মণগণ সুশ্রী, বৈশ্যরা হলুদ, ক্ষত্রিয় লাল এবং শূদ্ররা কাল" (মহাভারত, শান্তি পর্ব ১৮৮.৮)। ভরদ্বাজ এই বিভাগের কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, "আমরা সকলে আকাঙ্ক্ষা ক্রোধ,ভয়,দুঃখ,উদ্বগ,ক্ষুধা এবং শ্রমের দ্বারা আক্রান্ত হই, তখন বর্ণ বিভাগ কিভাবে করা হবে? কর্মের বিভাজন অনুসারে বর্ণ প্রথার প্রচলন হয়েছিল, শারীরিক রং এর মাধ্যমে নয়, ফলে দেখা যায় বংশানুক্রমিকভাবে বর্ণের এক কাঠামো তৈরি হয়েছিল যার ফলে পুত্র পিতার শিল্প দক্ষতা বা চারুশিল্পকে জীবন ধারার সাথে সংযোজন করে ফেলেছে এবং অনুরূপ ভাবে সমাজ সৃষ্টি হয়েছে।

বিবাহের ক্ষেত্রে এই বর্ণ প্রথার প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। অনুলোম বিবাহ(বর কন্যা হতে উচ্চবর্ণের) গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাই বিবাহ সন্তান সন্ততি পিতার বর্ণকে নিজের বর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে। প্রতিলোম (কন্যা বর হতে উচ্চবর্ণের) বিবাহে কোথাও বাধা নেই। মহাভারতের আদি পর্বে রাজা যযাতি ব্রাহ্মণ বংশের কন্যা দেবযানীকে বিবাহ করার কথা উল্লেখ আছে। দেবযানীর পিতা গুরু শুক্রাচার্য সম্মতি দিয়েছেন এ বিবাহে। লক্ষণীয় যে হিন্দু ধর্মের অনেক পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় চরিত্রেই ছিল অধবর্ণ। মহাভারতের জ্ঞানী মানুষ 'বিদুর' ছিলেন একজন শূদ্র মহিলার পুত্র। তার সঠিক পরিচয় রহস্যে ভরা। কথিত আছে রাজা ধৃতরাষ্ট্র কোন ধর্মীয় নির্দেশনার প্রয়োজন হলে বিদুরকে জিজ্ঞাসা করতেন। ঋষি বৈশিষ্ঠ্য একজন বারবণিতার ছেলে, ব্যাস জেলেনির পুত্র এবং পরাশর চণ্ডালিনীর ছেলে। বিভিন্ন হিন্দু গ্রন্থপঞ্জী ও দলিলপত্রে বংশানুক্রমিক বর্ণ ধর্মকে গ্রহণ করা হয়নি। তাদের মতে চরিত্র এবং কর্ম নির্ধারণ করবে কে কোন বর্ণের, জন্মে নয়। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণের ফলে একজন ব্রাহ্মণ হবেন, আবার শূদ্র পরিবারে জন্মের জন্য শূদ্র হবেন এটা সঠিক নয়। এমনকি সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কমচন্দ্র বলেছেন, যদি বেদ পড়িলে ব্রাহ্মণ হয়, তবে চগুালকে বেদ পড়াও। বর্ণ প্রথার পক্ষে ও বিপক্ষে দীর্ঘদিন ঐতিহাসিকভাবে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বর্ণবাদ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং মোটামুটি ভাবে প্রতিরোধ হয়েছে ভক্তিবাদের কাছে।

বৈষ্ণবগণ এর বিরোধিতা করেছেন প্রবল ভাবে।
তারা মনে করে,
            "বৈষ্ণব দেখিয়া যেবা জাতি বুদ্ধি করে
             তাহার সমান পাপী নাহিক সংসারে।"

অনেকে আবার মনে করেন বর্ণবাদই হিন্দুধর্মকে বিভিন্ন যুগে বিদেশি পরাশক্তির আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বর্ণবাদের কারণেই ব্যাপকভাবে ধর্মান্তর সম্ভব হয়নি। তাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে যতই বিতর্ক থাক না কেন "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই ",এই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের মর্মবাণী এবং এই মৌলিক ভাবধারার উপর হিন্দু ধর্মের মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিতাহার।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র