বৈদিক হিন্দুধর্ম

বৈদিক হিন্দুধর্ম

বেদ কোনও পাপ স্বীকার করেন না, শুধুমাত্র ভ্রান্তিকে স্বীকার করেন এবং সর্বাপেক্ষা বড় ভ্রান্তি, বেদের মতে, নিজেকে দুর্বল ও সর্বকালের পাপী মনে করা।

বৈদিক ধর্ম অথবা বেদে প্রতিপাদিত ধর্ম পৃথিবীতে যত ধর্মের কথা জানা যায় তার মধ্যে প্রাচীনতম স্তরের ধর্ম-চর্চা। ভারতে ১৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বেদের আবৃত্তি চলে আসছে। এই ধর্ম প্রায় ২০,০০০ বৎসর প্রাচীন, সভ্য জগতে এই বেদ কথিত ধর্ম থেকেই সকল ধর্মের সূত্রপাত। বেদ ভিত্তিক এই ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম, পরবর্তীকালে এর নাম হয় হিন্দুধর্ম অথবা বৈদিক হিন্দুধর্ম। আদিতে এর নাম ছিল সনাতন ধর্ম অর্থাৎ চিরাচরিত জীবনপন্থা।

৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সনাতন ধর্ম অবিঘ্নিত ছিল। আনুমানিক ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারত উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত থেকে আগত বিদেশী অশ্বারোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা ভারতীয়দের বলত হিন্দু অর্থাৎ সিন্ধুনদের তীরবর্তী অঞ্চলের সভ্যতা। শাসকদের প্রদত্ত নামটি স্থায়ী হয়ে গেল এবং সনাতন ধর্ম কালক্রমে হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত হল।

'সনাতন' -এর অর্থ নিত্য, চিরন্তন ;   'ধর্ম'-এর অর্থ মানবিকতাবাদী সৎজীবনে বিশ্বাস। এই বিদেশিদের দ্বারা ভারত আক্রমণের সময় থেকে কলিযুগ আরম্ভ হয়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তির কারণে বেদের গুরুত্ব। কলিযুগে বেদ সে-গুরুত্ব হারায় এবং আচার - অনুষ্ঠান সংক্রান্ত স্তোত্রগুলোর অন্তর্ভুক্তির কারণে কিয়ৎপরিমাণে অশুদ্ধ হয়ে পড়ে।

বৈদিক ধর্ম ভারতকে তার বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ভিত্তি - ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করে এবং অতি উচ্চমানবিক মূল্যবোধ ও সর্বজীবের প্রতি মমত্ববোধ দান করে। বেদের শক্তি নিহিত তার অলৌকিক ক্ষমতার মধ্যে।

যাঁরা নিয়মিত বেদ আবৃত্তি করেন তাঁদের পরিবার ও স্বজন - বর্গের ব্যাধির নিরাময় হয়, তাঁদের ঘিরে এক অদৃশ্য ঐশ্বরিক নিরাপত্তার বলয় সৃষ্টি হয়। আজ পর্যন্ত অনেক পরীক্ষা - নিরীক্ষা করে এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু এই অলৌকিক ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

প্রাকাশ্য স্থানে বহুজনের একত্রে বেদ আবৃত্তি বহুবার মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে জীবনদান করেছে। হিন্দুদের বিশ্বাস, নিয়মিত বেদ আবৃত্তি এবং বেদের উক্তির পালনে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাফল্য ও শান্তি দান করে।

বৈদিক ধর্মের পতন ঘটে যখন আনুমানিক ৪৫০০খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনর, ইউরোপ এবং পারস্য থেকে আক্রমণকারীরা সিন্ধুনদের উজানের অববাহিকা আক্রমণ করে। ইরানের ধর্মের ওপর বেদের প্রভাব জরুথুস্ত্রীয়দের অপেক্ষাও প্রাচীন, তাদের দর্শনের সঙ্গে বৈদিক ভারতের ধর্মের অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়।

মূল বেদসমূহ ছিল একেশ্বরবাদী, বলপূর্বক তার সঙ্গে ইরানের সূর্য এবং ইন্দ্র - পূজা এবং পশুবলির প্রথার মিশ্রণ ঘটানো হয়। ধার্মিক ধ্যান-ধারণার আদান-প্রদানের ফলে বিদেশীরা ভারতের স্বর্ণভাণ্ডারের এবং ঐশ্বর্যের হদিশ পায় এবং তারা আক্রমণকারীরূপে ভারতে আগমন করে। তাদের ধর্ম ও লোকাচার তারা ভারতে নিয়ে এসে স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়।

স্থানীয় অধিবাসীদের তারা সামাজিক ও মানসিকভাবে ধর্ষণ করে বিকলাঙ্গ করে দেয়, দমন করে। ভারতীয়েরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অহিংস ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস রাখে। দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতীয়রা শৃঙ্খলাবোধ, সমরবিদ্যা এবং আত্মরক্ষাকে কোনও দিন গুরুত্ব দেয়নি। তার ফলে ভারতীয়রা সর্বদাই দুর্বল থেকে গেছে, আক্রমণের শিকার হয়েছে।

বেদের অবশিষ্ট এখন যা আছে তা হল বেদ এর ওপর লেখা দেশি বিদেশিদের রচনাসমূহ। এইসব লেখা বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সুদীর্ঘ বিবরণ বেদের উৎপত্তি সংক্রান্ত। বেদের স্তোত্রসমূহ ঈশ্বর প্রথমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে দিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে সকলে একমত যে ঋষিগণের নিকট সেগুলোকে প্রকট করা হয়েছিল শত সহস্র বছর ধরে। বেদ মুখস্থ করে ঋষিগণ তা স্মৃতিতে রাখতেন। বেদের আধিপত্য ছিল ১৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, তারপরে হঠাৎ এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। আজ আমরা যে বেদ পাই, জার্মান এবং ব্রিটিশদের লিখিত এবং তাতে শুধুমাত্র আচার অনুষ্ঠানের কথা আছে। মূল বেদ এখনও কিছু ঋষিগণ ধরে রেখেছেন।

বৈদিক বিদ্যালয়গুলোর উত্থান ও পতনের সময়ে সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কয়েক শত বৈদিক বিদ্যালয়ের নাম পাওয়া যায়, কিন্তু কয়েকটি ছাড়া সেগুলোর কথা কিছু জানা যায় না। শুধুমাত্র কয়েকটির কিছু তথাকথিত রচনা অবশিষ্ট আছে, যেমন ঐতরেয় ও সাংখ্যায়ন, ঋগ্বেদ এবং অপস্তম্ভ এবং যজুর্বেদীয় ধারা ইত্যাদি।

সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রচনাগুলোই সর্বাপেক্ষা মূল্যবান। সেগুলো হল চারটি সংহিতা, যাকে বলা হয় বেদ। ব্যাপকতর অর্থে বেদ বলতে পরবর্তী রচনার সমগ্র ও অংশবিশেষও বোঝায়, কারণ সেগুলোর ভিত্তি ছিল চারটি সংহিতার কোনো একটি। চারটি বেদের নাম ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ।

ঋগ্বেদ 'কাব্যের বেদ' সংহিতাগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। তার প্রায় ১০০০ স্তোত্র ঈশ্বর নিবেদিত, এবং 'ওঁ' দ্বারা চিহ্নিত। অধিকাংশ স্তোত্র প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এক ঈশ্বরের কথাই বলে, কিন্তু সাধারণভাবে আচার - অনুষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক সুদূর, ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্ত ঈশ্বরকে উপলব্ধি করবার জন্যে রচিত।

"সামবেদ" অথবা মন্ত্রের বেদ প্রায় সমগ্রভাবেই ঋগ্বেদ থেকে আহৃত। সঙ্গীতের স্বরলিপি সহযোগে, ঈশ্বরের বাণী আকর্ষণীয় ও প্রীতিপ্রদভাবে সাধারণের মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত।

অথর্ববেদের বিষয় প্রধানত ব্যক্তিগত সম্পর্কসমূহ এবং বিবিধ আচার - অনুষ্ঠান।

কালানুক্রমিক ধারায় এর পাঠসম্ভবত 'ব্রাহ্মণ' - এর টীকাসমূহ। ব্রাহ্মণ' কোনো বর্ণের সম্পর্কিত নয়। এটি একটি গ্রন্থের নাম। সেগুলো আবৃত্তির উদ্দেশ্যে রচিত। এগুলো গদ্যরচনা, বিভিন্ন বেদ থেকে সংকলিত, বিভিন্ন বেদের সূত্রগুলো এবং আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যা হিসেবে রচিত।

' আরণ্যক' - গুলো ১২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত। সেগুলো গুহা জীবন ও অতিপ্রাকৃত চরিত্রের জন্যে অরণ্যের মধ্যে অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে রচিত। সেগুলোর মধ্যে প্রধানত আছে বিভিন্ন খণ্ড ও আচার অনুষ্ঠানের প্রতীকী ব্যাখ্যা। সবশেষে, সর্বাপেক্ষা মূল্যবান উপনিষদসমূহ ১৬,০০০-১০০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়ের মধ্যে রচিত। সর্বসাধারণের বোধগম্য করার উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক কাহিনী ও কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে প্রদত্ত দার্শনিক চিন্তার সংক্ষিপ্তসার সমন্বিত এই উপনিষদসমূহ। বৈদিক উপনিষদসমূহ সংখ্যায় তেরো।

সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদসমূহকে 'শ্রুতি' নামে অভিহিত করা হয়। তার অর্থ রচনাগুলো দৈব-প্রেরিত শ্রুত অংশ। আশ্চর্যের বিষয়, বেদের আবৃত্তি অলৌকিক ক্ষমতা দান করে, আজ পর্যন্ত যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। উল্লেখযোগ্য বিষয় এইটি যে, যদিও এক হাজার বৎসরের অধিক কাল ভারতবাসী বিদেশি বিধর্মী শাসনের অধীন ছিল, বৈদিক ভারত সনাতন ধর্ম অর্থাৎ হিন্দূধর্মে বিশ্বাসী থেকে গেছে। অন্য অনেক দেশ আক্রমণকারীদের ধর্মের চাপ সহ্য করতে না পেরে ধর্মান্তরিত হয়েছে। বেদের শিক্ষা ভারতবাসীদের অবিচল থাকার ঐশ্বরিক বল দান করেছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র