বর্ণভেদ প্রথা ইতিহাস

বর্ণভেদ প্রথা ইতিহাস

মধ্য এশিয়া থেকে আগত আক্রমণকারীদের সামাজিক শোষণ এবং নৈতিক ভ্রষ্টাচার কায়েম রাখার উদ্দেশ্য হিন্দুদের বিভক্ত ও দুর্বল করবার জন্যে এই বর্ণভেদ প্রথার প্রবর্তন। এই আক্রমণকারীদের আগমনের পূর্বে সাধারণত শ্রমকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হত অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য।

যাঁরা শিক্ষালাভ এবং শিক্ষাদানের জীবিকা বেছে নিতেন তাঁদের বলা হত ব্রাহ্মণ, যুদ্ধবিদ্যায় যাঁরা পারদর্শিতা লাভ করতে চাইতেন তাঁদের বলা হত ক্ষত্রিয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তি যাঁরা বৈষয়িক সম্পত্তি সৃষ্টিতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁদের বলা হত বৈশ্য এবং কারিগর ও সাধারণভাবে শিল্পনৈপুণ্যের অধিকারীদের বলা হত শূদ্র। প্রত্যেকে নিজের নিজের পছন্দ ও বিশেষ জ্ঞান ও কুশলতা অনুযায়ী কর্মে লিপ্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঋগ্বেদের যুগে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা বিভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করতেন।

আনুমানিক ৪৫০০ থেকে ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যাযাবর রক্তলোলুপ বিদেশী অশ্বারোহী সৈনিকেরা দলে দলে, বারে বারে স্বর্ণ লোভে ভারত আক্রমণ করে। নতুন শাসকেরা অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাগকে চার প্রধান বর্ণে বিভাজিত করেন। হিন্দুদের এর মাধ্যমে দুর্বল ও বিভক্ত জাতিতে পরিণত করা হয়।

এই চার শ্রেণী বিভাগের নাম ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা শিক্ষিত ছিল না এবং দুর্ভাগ্যবশত : বিশেষ কোনও রকম কুশলতা অর্জন করেনি, তাদের সম্পর্কে নতুন শাসকদের কোনও আগ্রহ ছিল না। তাদের বলা হল নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে। হাজার বছরের রাজনীতির দলনের শিকার হল এই দুর্ভাগা সৎ মানুষেরা, আজও তাদের বলা হয় দলিত।

বৃত্তিভেদপ্রথা হয়ে গেল বর্ণভেদপ্রথা। বৃত্তিভেদ ছিল এমন এক সমাজ ব্যবস্থা, যাতে সন্তান পিতার জ্ঞান ও কুশলতার উত্তরাধিকারী হত। সে যুগে কারিগরি শিক্ষার কোনও বিদ্যালয় ছিল না, কাগজ ছিল না, বই ছিল না। পরিবারের বাইরে কুশলতা অথবা জ্ঞান অর্জন করবার কোনো রাস্তা ছিল না। বংশপরম্পরায়, কারিগরি কুশলতা ও জ্ঞান সঞ্চারিত হত। এক বৃত্তি থেকে অন্য বৃত্তিতে অর্থাৎ এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে প্রবেশ হিন্দুদের মধ্যে প্রচালিত ছিল।

হিংসাবৃত্তি দ্বারা আক্রমণকারীরা শান্তিপ্রিয় দেশ ভারতকে পদানত করল ঠিকই, কিন্তু ভারতীয়দের নৈতিক সাহস ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা ছিল অটুট। আক্রমণকারীরা ভারতীয়দের মানসিকতার অবক্ষয় করতে পারল না। তখন তারা বর্ণভেদ প্রথার অপব্যবহার করে, অর্থনৈতিক শ্রমবিভাগকে তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসনে পরিবর্তিত করল এবং তাকে এমনভাবে পরিচালিত করল যেন বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে প্রাচীর অভেদ্য, যেন বর্ণভেদ একটি ধর্মীয় ব্যবস্থা। অশিক্ষিত, অবুঝ মানুষ বহু শতাব্দী ধরে এই রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে বাস করতে করতে ভ্রান্ত বিশ্বাসের শিকার হয়ে গেল।

বোঝা দরকার, পৃথিবীর সর্বত্র কোনও সামাজিক অন্যায়, দীর্ঘকাল প্রচালিত থাকলে, তা প্রায় আইনের বাধ্যবাধকতা লাভ করে। বৃত্তিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথাকে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে অভেদ্য অনতিক্রমণীয় প্রাচীরে রূপান্তরিত করা হিন্দু সমাজের সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ।

চতুর রাজনীতিকেরা যুগে যুগে এই সামাজিক অন্যায়ের সুযোগে সমাজকে বিভক্ত করে অপশাসন ও সামাজিক শোষণ করেছেন। যাঁরা এর দ্বারা লাভবান হয়েছেন তাঁরা এঁকে সমর্থন করেছেন।

সনাতন ধর্মের দর্শন হিন্দুদের প্রচণ্ড নৈতিক বল দান করেছে যুগে যুগে। হিন্দু দর্শন মানবতার শ্রেষ্ঠ দর্শন। এই দর্শন ঈশ্বর প্রেরিত তাই হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা আক্রমণকারীদের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল।

আক্রমণকারীরা ছিল অশ্বারোহী, দ্রুতগামী এবং নৃশংস ও হত্যায় সিদ্ধহস্ত। যতটুকু সাফল্য তারা পেয়েছে, তা মৃত্যুভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে শ্রদ্ধার মাধ্যমে নয়।

নতুন প্রভুরা ভণ্ড, মিথ্যাচারীদের সহায়তায় হিন্দুদের বিভক্ত ও দুর্বল করে রাখল। ভণ্ড অর্থাৎ যারা পঞ্চমবাহিনী, তারা ধার্মিক হিন্দু ও মানবতাবাদীর ছন্দবেশে প্রকৃতপক্ষে সমাজকে ধ্বংস করে দিল, তাদের নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ,  আত্মম্ভরিতা ও লোভকে চরিতার্থ করবার জন্যে, ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট করবার জন্যে বহুবার বহুপথে তারা মানুষকে পথভ্রান্ত করেছে, নানা অজুহাতে বিদেশীদের ভারতে এসে হিন্দুদের লুট করবার পথ প্রশস্ত করেছে।

বিপুল সংখ্যক দেশবাসী ছিল নিরক্ষর, অজ্ঞান, ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী, অপরিসীম দারিদ্র্যে পীড়িত। কালক্রমে নতুন শাসনকর্তাদের রাজসভায় কায়েমি স্বার্থ গজিয়ে উঠল। স্বল্প পরিমাণ সম্পদ যা ছিল, হস্তগত করবার জন্যে প্রত্যেক গোষ্ঠী প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেক গোষ্ঠীর মধ্যে 'নিজেদের লোক' এবং 'বাইরের লোক', এই মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠল।

হাজার হাজার বৎসর ধরে এই অর্থনৈতিক ভেদ বর্ণভেদ প্রথাকে এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত করল। এই শোষণকে চিরস্থায়ী করবার জন্যে ভণ্ডেরা দুরভিসন্ধি পরায়ণ হয়ে একে ধর্মের বাহ্যিক রূপ দান করল। গীতায় পরিষ্কার বলা হয়েছে বর্ণ পেশাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মভেদ এবং মানুষের প্রবর্তিত কর্মবিভাগ। ঈশ্বর অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিংশা পূদ্রাং চ পরংতপ
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাব প্রভবৈর্গুণেঃ।

অর্থব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের এবং শূদ্ররও উপাধি ভেদ হবে তাহাদের বৃত্তিগত গুণাবলীর প্রকাশ অনুযায়ী।

চাতুর্বর্ন্‌ ময়া সৃষ্টম্‌ গুনকর্ম বিভাগশঃ ।
তস্য কর্তরম্‌ অপি মাম্‌ বিদ্ধি অকর্তারম্‌ অব্যয়ম্‌।।

অর্থ,  প্রকির্তির তিনটি গুন এবং কর্ম অনুসারে আমি মানুষ সমাজে চারিটি বর্নবিভাগ সৃষ্টি করিয়ছি । আমিই এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।

মহাভারতের বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের চার ভাই এক যক্ষের পুকুরে বিনা অনুমতিতে জলপান করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যুধষ্ঠির যখন খুঁজতে এসে চার ভাইকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে যক্ষকে প্রার্থনা করেন যেন যক্ষ চার ভাইকে উজ্জীবিত করে তোলেন। যক্ষ বলেন যে যুধিষ্ঠির যদি তার বারটি ধর্ম সম্বন্ধীয় প্রশ্নের উত্তর ঠিকমত দিতে পারেন, তবেই যক্ষ চার ভাইকে বাঁচাবার ওষুধ দেবেন।

যুধিষ্ঠির উত্তর দিতে রাজি হলে যক্ষর নবম প্রশ্নটি ছিল-

"ব্রাহ্মণ হতে হলে কি একমাত্র জন্মসূত্রেই ব্রাহ্মণ হতে হবে? অথবা চরিত্রের সততা ও মাধুর্য্য দ্বারা ব্রাহ্মণ হওয়া যায় নাকি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অথবা প্রজ্ঞা লাভের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ হওয়া যায়"।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির উত্তর দেন-

"ব্রাহ্মণ হওয়া যায় সৎ মধুর চরিত্র গঠনের মাধ্যমে। জন্মসূত্র, জ্ঞান অর্জন বা প্রজ্ঞা কাউকে ব্রাহ্মণ করে না"।

এটা একটা ধর্মমত প্রমাণ যে ইচ্ছা, পরিশ্রম ও কর্মকুশলতার মাধ্যমে মানুষ বর্ণভেদ প্রথার ওপরে উঠে স্ব-ইচ্ছায় নিজ বর্ণপরিচিতি নিতে পারে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসাধুতা দ্বারা উৎপন্ন জাতিভেদ প্রথা হিন্দুধর্মের মত একটি নির্মল ঈশ্বর প্রদত্ত ধর্মকেও প্রায় আবর্জনাস্তূপে পরিণত করেছে। হিন্দুরা পৃথকান্ন পরিবার হয়ে দাঁড়ায়। সনাতন ধর্ম অর্থাৎ হিন্দুধর্ম কোনও দিনই বর্ণভেদবাদের নির্দেশ দেয়নি। কিন্তু হিন্দুধর্মের ধর্মাবলম্বীরা বাধ্য হয়ে এবং অজ্ঞতাবশে বহু শতাব্দী ধরে তা পালন করে এবং ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন যে, বর্ণভেদ প্রথার অনুসারীরা দরিদ্র, দুর্বল এবং দাস হয়ে থাকবে।

কথিত আছে, ঈশ্বর বিধান দিয়েছেন, যে কেউ বর্ণভেদপ্রথা অস্বীকার করে হিন্দুদের ঐক্যের জন্যে চেষ্টা করবেন, তিনি অনন্ত স্বর্গ প্রাপ্ত হবেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরাও স্বর্গবাসী হবেন।

বর্ণভেদপ্রথা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, ধর্মীয় বিধান নয়, তার বহু প্রমাণ আছে। বঙ্গ দেশের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে এক শক্তিশালী নরপতি ছিলেন। তাঁর নাম ছিল বল্লাল সেন। তাঁর রাজত্বকালে নাথ ব্রাহ্মণ (তাঁদের রুদ্র ব্রাহ্মণও বলা হত) ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চবর্ণ বলে পরিগণিত হতেন এবং রাজপুরোহিত হিসেবে কাজ করতেন।

পীতাম্বর নাথ ছিলেন রাজা বল্লাল সেনের রাজপুরোহিত, বল্লাল সেনের পিতার যখন মৃত্যু হয়, রাজা চাইলেন তাঁর গুরু পীতাম্বর নাথ মৃতের পিণ্ড গ্রহণ করুন রাজার দান হিসেবে।

পীতাম্বর নাথ কোন মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো দান গ্রহণ করতে অাস্বীকার করেন। এই প্রত্যাখ্যান রাজা অপমান জ্ঞান করেন এবং আহত আত্মাভিমানে ও ক্রোধে শ্রীপীতাম্বর নাথের উপবীত কেড়ে নিয়ে বঙ্গরাজ্যে প্রচার করলেন রুদ্রজ ব্রাহ্মণ / নাথ ব্রাহ্মণ (অর্থাৎ উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ) বলে গণ্য ব্যক্তিরা এরপর থেকে শূদ্র হিসেবে গণ্য হবেন। তার ফলে তদবধি রুদ্রজ / নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা বঙ্গ দেশে শূদ্র হিসেবে গণ্য হন এবং বঙ্গ -দেশের বাইরে সেই একই নাথেরা ব্রাহ্মণ পুরোহিত হিসেবে শ্রদ্ধার পাত্র। এই একটি দৃষ্টান্ত থেকে প্রমাণ হয়, বর্ণভেদ প্রথা হিন্দুধর্মের অঙ্গ নয়, চতুর রাজনীতিকদের দ্বারা কৃত রাজনৈতিক শোষণ। পুরাণে অর্থাৎ প্রাচীন শাস্ত্রে কথিত আছে যে, নাথ ব্রাহ্মণেরা (অর্থাৎ রুদ্র বাহ্মণ)  ভগবান শিব, যিনি রুদ্র নামেও অভিহিত তারই বংশধরগন । নেপালে(যেটি একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র) এখন পর্যন্ত রাজপুরোহিত একজন নাথ ব্রাহ্মণ। কলকাতায় বিখ্যাত কালী মন্দিরের প্রথম প্ররোহিত ছিলেন শ্রীচৌরঙ্গী নাথ। কলকাতায় একটি প্রধান রাজপথের নামকরণ হয়েছিল তাঁর স্মৃতিতে। সেটি চৌরঙ্গী রোড নামে পরিচিত ছিল। অন্য বিখ্যাত নাথেরা ছিলেন সোমনাথ, গোরখনাথ প্রভৃতি, যাঁদের স্মৃতিতে যথাক্রমে বিশাল সোমনাথ মন্দির (গুজরাট) এবং গোরখনাথ মন্দির (উত্তর প্রদেশ) নির্মিত হয়। এই সব তথ্য আবার প্রমাণ করে যে, বর্ণভেদ প্রথার উৎপত্তি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, কর্মবিতরণ ও রাজনৈতিক শোষণ থেকে। প্রকৃত হিন্দুধর্ম বর্ণভেদ প্রথার বিরোধী।

ইতিহাস বলে ভারতে গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা বহু  ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই জীবিকা অর্জনের জন্য কারিগরের বৃত্তি অবলম্বন করতেন। ময়ূরশর্মা নামক এক ব্রাহ্মণ যোদ্ধার বৃত্তি গ্রহণ করে প্রসিদ্ধ হন এবং কদম্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আরেকজন ব্রাহ্মণ, মাতৃবিষ্ণু, ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি অবলম্বন করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে একটি প্রদেশের শাসক হন। প্রদোষ বর্মণ জাতিতে শূদ্র ছিলেন, কিন্তু তাঁর বৃত্তি ছিল ক্ষত্রিয়ের এবং তিনিও একটি প্রদেশের শাসক হয়েছিলেন । গুপ্তযুগে অনেক ব্রাহ্মণ বনে জঙ্গলে শিকারীর কাজ করতেন কারণ তা ছিল অর্থকরী পেশা। শূদ্র বংশজাতরা মান্ডাশোরের বিখ্যাত সূর্য মন্দির নির্মাণ করেন। এই সব দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে হিন্দুধর্মে বর্ণভেদপ্রথা কেবলমাত্র শ্রমবিভাগ ছাড়া আর কিছুই নয়।

বৈদিগ যুগে শূদ্র অথবা অন্য কাউকে অস্পৃশ্য অথবা দলিত জ্ঞান করার ধারণা প্রচলিত ছিল না। কাউকে ঘৃণ্য মনে করা হত প্রধানত তার বৃত্তি এবং ব্যবহার সমাজে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে। তবে, সমাজে নিন্দিত অবস্থা অনুশোচনা দ্বারা অথবা বৃত্তি পরিবর্তনের দ্বারা সংশোধিত করে নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল।

প্রাচীন যুগে ছাত্রাবস্থা দীর্ঘকাল ব্যাপী ছিল এবং আশ্রমে বনবাসের মত কঠোর জীবনযাপন করতে হত। গুরু - শিষ্যের মধ্যে জ্ঞানের আদান - প্রদান হত। সাধারণত শিক্ষা দান করা হতো মৌখিকভাবে কারণ লিখিত পুঁথি সহজলভ্য ছিল না

পক্ষান্তরে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শুদ্র ও বৈশ্য পরিবারের সন্তানদের (পারিবারিক বৃত্তি অথবা ব্যবসায়ের স্বাভাবিক সংস্পর্শের কারণে) একটা পারিবারিক কর্মের প্রবণতা প্রথম থেকেই তৈরি হত এবং পিতামাতারা সহজেই তাঁদের পরম্পরাগত বৃত্তিতে প্রবেশ করিয়ে নিতে পারতেন।

কালক্রমে বৃত্তি নির্বাচনের এই প্রথা অজ্ঞাতসারেই সম্পূর্ণ পরিবার ভিত্তিক বৃত্তির কারণ হল, যদিও সমাজ সে রকম পরিণতির আকাঙ্খা করেনি। এই বিষয়ে হিন্দুসমাজে কঠোরতা ছিল না। কে কী বৃত্তি অবলম্বন করবে তাতে তার স্বাধীনতা ছিল। (যেমন,সত্যকাম জন্মসূত্রে শূদ্র ছিলেন, কিন্তু বেদাধ্যয়ন করে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে বিপুল শ্রদ্ধা অর্জন করেন।) বৈদিক যুগে যে কেউ পুরোহিত হতে পারতেন। ব্রাহ্মণের জন্য সে পদ সংরক্ষিত রাখার কোনও প্রশ্ন ছিল না।

পবিত্রাত্মা সংযতেন্দ্রিয় পোশালাং মধু জীয়বা চ
তং গুরু শ্রদ্ধয়া শৃনু উপহার চ প্রয়চ্ছতু।

অর্থ,  যারা অন্তর পবিত্র, প্রবৃত্তিসমূহ নিয়ন্ত্রণের অধীন এবং সুরসংযোগে যিনি শ্লোক আবৃত্তি করতে পারেন, তিনিই পুরোহিত হিসেবে মন্ত উচ্চারণের মাধ্যমে প্রার্থনা পরিচালনা করবার অধিকারী এবং তাকে ভক্তগণের প্রভূত পরিমাণ দান করতে হবে যেন তিনি সচ্ছন্দ ও উন্নত পারিবারিক জীবন যাপন করতে পারেন।

বৃত্তি বিবেচনায় বিবাহ একই বর্ণের মধ্যে হওয়া সুবিধাজনক বিবেচনা করা হত, একই ধরনের পারিবারিক পরিবেশ থেকে আসার কারণে পরিবারের ব্যবসায়ে প্রবেশ করতে দেরি হত না, অসুবিধা হত না এবং অতিরিক্ত কোনও শিক্ষানবিশির প্রয়োজন হত না। উপরন্তু এই ধরনের বিবাহের ব্যবস্থায় বর ও কন্যার বিবাহের পরে অপ্রত্যাশিত, অপরিচিত, অমিত্র-সুলভ ও অবাঞ্ছিত সামাজিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকত।

যাদের মধ্যে পারিবারিক পরিবেশের দিক থেকে বিপুল পার্থক্য ছিল এমন পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহও হতে পারত এবং প্রায়ই ঘটত। মহাভারতের ইতিহাস বলে এক শূদ্র ধীবরের কন্যা সত্যবতীর সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজা শান্তনুর বিবাহে সমাজ কোনও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেনি।

বর্ণভেদপ্রথা ছিল এক অর্থনৈতিক প্রথা। কাজের সুবিধার জন্য লোক তাদের পারিবারিক বৃত্তিই অবলম্বন করে থাকত এবং একই ধরনের পরিবারের মধ্যে অর্থাৎ একই ধরনের বৃত্তির লোকেরা মধ্যে সাধারণত বিবাহ হত। এই বিষয়ে সাম বেদের একটি শ্লোক প্রাসঙ্গিক : ঈশ্বর শোষণ পছন্দ করেন না। তিনি চান তাঁর ভক্তেরা সকলের সঙ্গে সমব্যবহার করুন, পীড়িতের সেবা করুন।

যো দদাতি বুভূক্ষিতেভ্য পিড়িতানাং সহায়ক :
দুঃখার্তাণাং সমাশিলষ্যতি তমেব ইশঃ প্রসীদতি।

অর্থ, ঈশ্বর খুশি হন, যখন তুমি সমব্যবহারের মাধ্যমে কোনও মানুষের চিত্ত আনন্দিত কর, ক্ষুধার্তকে অন্নদান কর, আর্তকে সাহায্য কর, দুঃখীর দুঃখ ভার লাঘব কর, অত্যাচারিতের প্রতি অন্যায় আচরণের অবসান কর।

হাজার বৎসর ব্যাপী বিদেশীয় দাসত্বের পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে, সামাজিক ভেদনীতি অর্থাৎ জাতিভেদ প্রথা নির্মুল করার অধিকার লাভ করে। দীর্ঘকাল বর্ণের ভিত্তিতে যারা বঞ্চিত হয়ে এসেছে তাদের জন্যে ভারত সরকার চাকরিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জাতিভেদ প্রথা ভারতে আইনত দণ্ডনীয়, এখানে বাংলাদেশের হিন্দুরা পিছিয়ে থাকলেও, আধুনিক শিক্ষিত ভারতীয় জাতিভেদ প্রথাকে ঘৃণা করে এবং এই বিষয়ে আলোচনা হলে লজ্জিত হয় ও অপ্রতিভতা বোধ করে।
#সমপ্ত

মন্তব্যসমূহ

Dhana dey বলেছেন…
ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো, জানতে পেরে খুব খুশি হলাম ।
Kritti Bas Roy বলেছেন…
আ‌নেক ধন্যবাদ এই প্রচার আ‌রো জরা‌লো হওয়া উ‌চিত
খুব ভাল লাগল। স্বার্থবাদীদের দুরভিসন্ধী মানব সমাজে এভাবে সমস্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু তা চিরস্থায়ী নহে। সত্য প্রকট হবেই। ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন।ধন্যবাদ।
খুব ভাল লাগল। স্বার্থবাদীদের দুরভিসন্ধী মানব সমাজে এভাবে সমস্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু তা চিরস্থায়ী নহে। সত্য প্রকট হবেই। ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন।ধন্যবাদ।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র