বিষ্ণুর দশ অবতার চক্র

বিষ্ণুর দশ অবতার চক্র

হিন্দু দর্শনে 'দশাবতার' চক্রর মাধ্যমে যে দশ জন অবতারকে (মৎস,কূর্ম, বরাহ,নরসিংহ, বামন,পরশুরাম, রাম,কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কি)  সাজানো হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ক্রমবিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। বহু সময় আগে সূর্য অংশ বহু বছর আবার্তিত হতে হতে ঘনীভূত ও শাতল হয়ে তৈরী হয় পৃথিবী গ্রহ। সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী ছিল জলময়। সেই জলের প্রথম প্রাণীই হল মীন বা মৎস (প্যালিয়োজোয়িক কল্পের সিলুরিয়ান-ডিভোনিয়ান যুগকেই মৎস যুগ বলে) এই সময় ভগবান, মীনরূপে বেদোদ্ধার করেছিলেন। এই বেদ কিন্তু গ্রন্থ নয়, সৃষ্টি জ্ঞান। তখন সে পারঙ্গম হয়েছে বংশ রক্ষায়, যা ছিল সে যুগের জীবনবেদ।  মন্ত্র ছিল-

                  গোত্রং নো বর্ধতাম্।

এলেন দ্বিতীয় অবতার - কূর্ম। জল ছেড়ে সে ডাঙ্গায় উঠতে শিখেছে, অর্থাৎ উভয়চর প্রাণী, শিখেছে বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে  (ডিভোনিয়ান-কার্বনিফেরাস যুগ) কূর্ম, জল থেকে কাদা মেখে ডাঙ্গায় উঠে এল - এটাই হল তার ধরণী-ধারণ।

তৃতীয় অবতার  - বরাহ। সে এখন ডাঙ্গার প্রাণী হলেও জলের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি - বাস করে কাদায়। বিবর্তিত হয়েছে স্তন্যপায়ী জীবে-শিখেছে সন্তান প্রসব করতে (সেনোজোয়িক কল্পর প্যালিয়োসিন-ইয়োসিন যুগ) স্বভাবত ধর্মই হল দন্তাঘাতে মৃত্তিকা বিদারণ।

চতুর্থ অবতার - নৃসিংহ (অর্ধেক পশু আর অর্ধের মানুষ) অর্থাৎ ট্রানজিশন ফেজ (যেমন আধুনিক শিম্পাঞ্জি,  ওরাংওটাং ইত্যাদি)। (অলিগোসিন-মাইয়োসিন যুগ) ভগবান নৃসিংহ, হিরণ্যকশিপু নামে দৈত্যকে নখ -তাড়নে বিনাশ করেছিলেন। বিবর্তনের পথে এক বিশেষ প্রতিকূল শক্তি, প্রকৃতির স্বাভাবিক গ্রাসাচ্ছাদন নষ্ট করত। এই গ্রাসাচ্ছাদন হল বনজাত কদলী। সেই কলা গাছের শত্রু এক ধরনের কেঁচো(কলাগাছ সাধারণত আদ্র জায়গায় জন্মায় বলেই কেঁচোর উপদ্রব বেশি) এই কেঁচোর নাম হিরণ্যকশিপু। নরহরি তার নখ-তারনে কেঁচোগুলোকে ধ্বংস করে ভাবী মনুষ্য প্রজাতির জীবন ধারনের অাদি খাদ্যকে সংরক্ষিত করেন (আজও শিম্পাঞ্জি, বেবুন, ওরাংওটাং প্রভৃতি প্রাণীরা কেঁচো জাতীয় কীটের স্বভাব শত্রু। এরা প্রধানত নিরামিষাশী হলেও সকলেই অল্পবিস্তর কীট -ভূক) কলা মানুষের অন্যতম আদি খাদ্য, তাই আজও এই পরম উপকারি কলাগাছ হিন্দুদের সব রকম মাঙ্গলিক কাজে ব্যবহৃত হয়।

এরপর এলেন পঞ্চম অবতার -  বামন-হুবহু রামাপিথেকাস, অর্থাৎ হমোগণের শুভ আবির্ভাব (প্লাইয়োসিন যুগের  কথা) মাঝে মাঝে সে দুপায়ে উঠে দাঁড়ালেও চলতে গেলে অল্পবিস্তর হাতের সাহায্য লাগে,উচ্চতায় সে বর্তমান মানুষের অর্ধেক।

এরপর ষষ্ঠ অবতার, এলেন পূর্ণ মানুষের রূপ নিয়ে পরশুরাম -তাঁর শ্রী করে পরশু বা কুঠার। তিনি দৈহিক ক্ষমতাবলে  ক্ষাত্রধর্মী নন, তাঁর শক্তি মস্তিস্কবল-তাই ব্রাহ্মণ। তিনি আগুণের ব্যবহার জানেন-তাই অগ্নিহোত্রী। ভগবান পরশুরাম সহস্রবহু কার্তবীযার্জুনকে নিধন করে, একুশবার ক্ষত্রিয়কুল নির্মূল করেন, আর আপন গর্ভধারিণী মাতা রেণুকাকে কুঠারাঘাত করেছিলেন। মানুষের সহস্রবহু হয় না, কিন্তু ক্ষেত্রজাত অর্জুন গাছ সে তো মহীরূহ। তার সহস্র বাহু বা শাখা প্রশাখাকে কুঠারের আঘাতে ছেদন করে একুশ বার নিঃক্ষত্রিয় (জঙ্গল পরিস্কার) করে তিনি মানুষের বসবাসযোগ্য জমি তৈরী করেছিলেন। আর কৃষির প্রথম প্রচেষ্টা স্বরূপ মাতা ধরিত্রীর বুকে কুঠারাঘাত করে মাটি রেণু রেণু করেছিলেন। এতদিন পাশবিক যুগের অবসানান্তে দেখা দিল - মানব সভ্যতার অরুণালোক।

এরপর আবির্ভূত হন সীতাপতি শ্রীরাম। তিনি ছিলেন সপ্তম অবতার, তিনি ধনুর্বাণধারী। এই দূরক্ষেপী অস্ত্রর কাছে পরশুর অনুপযোগিতা প্রমাণিত হওয়ায় - দর্পচূর্ণ হল পরশুরামের। চিরবিদায় নিতে হল পুরাতনীকে। এক রাম জঙ্গল পরিস্কার করে রেখেছিলেন, আর এক রাম তাতে শুরু করলেন নতুন আবাদ - মানবিকতা। দেখা দিল স্থায়ী জনপদ - রাজ্য - গোষ্ঠীপতি, এলেন রাজা। ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম বিবর্তিত হলেন ধনুর্ধর শ্রীরামে।
এই যুগেই আবার দ্বিতীয় দফায় উন্নততর কৃষি ব্যবস্থার প্রচেষ্টা শুরু হল - এ হল তাঁর অহল্যা উদ্ধার' (হলের সাহায্য অস্পষ্ট অর্থাৎ অনাবাদী জমি)। আর তাঁর সীতাপতি নামটাও সার্থক, কারণ সীতা অর্থে লাঙ্গলের ফলা। এই হল জ্ঞানময় রূপ। মিথিলার জনকরাজ কৃষিজমিতে সীতা (লাঙ্গলের ফলাকে বলা হয় সীতা) আবিস্কার করেন। কিন্তু জনকরাজের আবিস্কৃত লাঙ্গলের ফলা অর্থাৎ সীতাকে বহুল প্রচার এবং ব্যবহারের মাধ্যমে হিন্দু জনমানষে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীরাম।
অর্থাৎ মাতা যেমন সন্তানের জীবন রক্ষা করেন তেমনই কৃষি প্রধান ভারতের জনসমূহকে লাঙ্গলের বহুল প্রচারের মাধ্যমে শ্রীরাম জীবন ধারণের পথ প্রদর্শন করলেন এবং হলেন বিষ্ণুর সপ্তম অবতার।

কাটল আরও বহু বছর, এলেন অষ্টম অবতার ভগবন শ্রীকৃষ্ণ। কৃষি সভ্যতার পূর্ণ প্রকাশ হল।বৈদিক আরণ্যক সভ্যতা আর পৌরাণিক কৃষি সভ্যতা। ফলে কৃষি পেল পূর্ণতা, জ্ঞানের হল চরমোৎকর্ষ - নরদেহেই  যুগে আবির্ভূত হলেন পূর্ণ ব্রহ্ম নারায়ণ অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

তারপর শুরু হল ঐতিহাসিক যুগ, আবির্ভূত হলেন নবম অবতার - সিদ্ধার্থ গৌতম বা বুদ্ধদেব। মাত্র তিনটে কথায় বলে গেলেন জীবনের অমৃত মন্ত্র - অহিংসা পরম ধর্ম। এতদিন জ্ঞানময় পূর্ণতা লাভ করে - আনন্দময় রূপে।

বিষ্ণুর দশম অবতার হলেন কল্কি। ভবিষ্যৎবাণী হল যে কল্কি থার্মো-নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের সাহায্যে মানব সমাজের দুঃখ দুর্দশা দূর করবেন।

🌹দশাবতার ধারিণে কৃষ্ণায় তুভ্যম্ নম:।🌹

এই অ্যাপ্লিকেশান এর সমস্ত তথ্য ধর্মীয় বই থেকে নেয়া হয়েছে। যদি কোনো জায়গায় ভুল তথ্য পান, তাহলে আমাদের জানাবেন, আমরা ঠিক করে দিবো...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র