ত্রয়োদশ অধ্যায়ঃ ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিভাগযোগ
ত্রয়োদশ অধ্যায়
অর্জুন কহিলেন - হে কেশব, প্রকৃতি ও পুরুষ, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ এবং জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইগুলি জানিতে আমি ইচ্ছা করি । (প্রক্ষিপ্ত ? শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য ও শ্রীধরস্বামী এই শ্লোকটি গ্রহণ করেন নাই ।) শ্রীভগবান্ কহিলেন, - হে কৌন্তেয়, এই দেহকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং যিনি এই ক্ষেত্রকে জানেন (অর্থাৎ ‘আমি’ ‘আমার’ এইরূপ মনে করেন) তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ (জীবাত্মা); ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবেত্তা পণ্ডিতগণ এইরূপ বলিয়া থাকেন । ১
হে ভারত, সমুদয় ক্ষেত্রে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, ইহাই আমার মত । অথবা ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের যে জ্ঞান তাহাই আমার (পরমেশ্বরের) জ্ঞান, ইহাই সর্বসম্মত । ২
সেই ক্ষেত্র কি, উহা কি প্রকার, উহা কি প্রকার বিকার-বিশিষ্ট, ইহার মধ্যেও কি হইতে কি হয়, এবং সেই ক্ষেত্রজ্ঞ কে এবং তাহার প্রভাব কিরূপ, এইসকল তত্ত্ব সংক্ষেপে আমার নিকট শ্রবণ কর । ৩
ঋষিগণ কর্তৃক নানা ছন্দে পৃথক্ পৃথক্ নানা প্রকারে এই ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ব্রহ্মসূত্র-পদসমূহেও যুক্তিযুক্ত বিচারসহ নিঃসন্দিগ্ধরূপে এই বিষয় ব্যাখ্যাত হইয়াছে । ৪
ক্ষিতি আদি পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি (মহত্তত্ত্ব), মূল প্রকৃতি, দশ ইন্দ্রিয়, মন এবং রূপরসাদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (পঞ্চতন্মাত্র) এবং ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা ও ধৃতি এই সমুদয়কে সবিকার ক্ষেত্র বলে । ৫,৬
শ্লাঘা-রাহিত্য, দম্ভ-রাহিত্য, অহিংসা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, শৌচ, সৎকার্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, বিষয়-বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা, জন্ম-মৃত্যু-জরাব্যাধিতে দুঃখ দর্শন, বিষয়ে বা কর্মে অনাসক্তি, স্ত্রীপুত্রগৃহাদিতে মমত্ববোধের অভাব, ইষ্টানিষ্টলাভে সমচিত্ততা, আমাতে (ভগবান্ বাসুদেবে) অনন্যচিত্তে ঐকান্তিক ভক্তি, পবিত্র নির্জন স্থানে বাস, প্রাকৃত জনসমাজে বিরক্তি, সর্বতা অধ্যাত্মজ্ঞানের অনুশীলন (নিত্য আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা), তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন আলোচনা - এই সকলকে জ্ঞান বলা হয়; ইহার বিপরীত যাহা তাহা অজ্ঞান । ৭-১১
যাহা জ্ঞাতব্য বস্তু, যাহা জ্ঞাত হইলে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করা যায়, তাহা বলিতেছি; তাহা আদ্যন্তহীন, আমার নির্বিশেষ স্বরূপ-ব্রহ্ম; তৎসন্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন । ১২
সর্বদিকে তাঁহার হস্তপদ, সর্বদিকে তাঁহার চক্ষু, মস্তক ও মুখ, সর্বদিকে তাহার কর্ণঃ এইরূপে এই লোকে সমস্ত পদার্থ ব্যাপিয়া তিনি অবস্থিত আছেন । ১৩
তিনি চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয় বৃত্তিতে প্রকাশমান অথচ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিত, নিঃসঙ্গ অর্থাৎ সর্বসঙ্গশূন্য অথচ সকলের আধারস্বরূপ, নির্গুণ অথচ সত্ত্বাদি-গুণের ভোক্তা বা পালক । ১৪
সর্বভূতের অন্তরে এবং বাহিরেও তিনি; চল এবং অচলও তিনি; সূক্ষ্মতাবশতঃ তিনি অবিজ্ঞেয়; এবং তিনি দূরে থাকিয়াও নিকটে স্থিত । ১৫
তিনি (তত্ত্বতঃ বা স্বরূপতঃ) অপরিচ্ছিন্ন হইলেও সর্বভূতে ভিন্ন-ভিন্ন বলিয়া প্রতীত হন । তাঁহাকে ভূতসকলের পালনকর্তা, সংহর্তা ও সৃষ্টিকর্তা বলিয়া জানিবে । ১৬
তিনি জ্যোতিসকলেরও (সূর্যাদিরও) জ্যোতিঃ; তিনি তমের অর্থাৎ অবিদ্যারূপ অন্ধকারের অতীত, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিতে প্রকাশমান জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয় তত্ত্ব, তিনি জ্ঞানের দ্বারা লভ্য, তিনি সর্বভূতের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন । ১৭
এই প্রকারে ক্ষেত্র, জ্ঞান এবং জ্ঞেয় কাহাকে বলে সংক্ষেপে কথিত হইল । আমার ভক্ত ইহা জানিয়া আমার ভাব বা স্বরূপ বুঝিতে পারেন, বা আমার দিব্য প্রকৃতি প্রাপ্ত হন । ১৮
প্রকৃতি ও পুরুষ, উভয়কেই অনাদি বলিয়া জানিও । দেহেন্দ্রিয়াদি বিকারসমূহ এবং সুখ, দুঃখ, মোহাদি গুণসমূহ প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে জানিবে । ১৯
শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রকৃতিই কারণ, এবং সুখ, দুঃখ ভোগ বিষয়ে পুরুষই (ক্ষেত্রজ্ঞ) কারণ বলিয়া উক্ত হন । ২০
পুরুষ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন এবং গুণসমূহের সংসর্গই পুরুষের সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের কারণ হয় । ২১
এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলিয়া উক্ত হন । ২২
যিনি এই প্রকার পুরুষতত্ত্ব এবং বিকারাদি গুণ সহিত প্রকৃতিতত্ত্ব অবগত হন, তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন, পুনরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন । ২৩
কেহ কেহ (স্বয়ং) আপনি আপনাতেই ধ্যানের দ্বারা আত্ম দর্শন করেন । কেহ-কেহ সাংখ্যযোগ দ্বারা এবং অন্য কেহ-কেহ কর্মযোগের দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন । ২৪
আবার অন্য কেহ-কেহ এইরূপ আপনা আপনি আত্মাকে না জানিয়া অন্যের নিকট শুনিয়া উপাসনা করেন । শ্রদ্ধাপূর্বক উপদেশ শ্রবণ করিয়া উপাসনা করতঃ তাঁহারাও মৃত্যুকে অতিক্রম করেন । ২৫
হে ভরতর্ষভ, স্থাবর, জঙ্গম যত কিছু পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহা সমস্তই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগ হইতে হইয়া থাকে জানিবে । ২৬
যিনি সর্বভূতে সমভাবে অবস্থিত এবং সমস্ত বিনষ্ট হইলেও যিনি বিনষ্ট হন না, সেই পরমেশ্বরকে যিনি সম্যক দর্শন করিয়াছেন, তিনিই যথার্থদর্শী । ২৭
যিনি সর্বভূতে সমান ও সমভাবে অবস্থিত ঈশরকে দর্শন করেন, তিনি আত্মাদ্বারা আত্মাকে হনন করেন না এবং সেই হেতু তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন । ২৮
প্রকৃতিই সমস্ত প্রকারে সমস্ত কর্ম করেন এবং আত্মা অকর্তা, ইহা যিনি দর্শন করেন তিনিই যথার্থদর্শী । ২৯
যখন তত্ত্বদর্শী সাধক ভূতসমূহের পৃথক্ পৃথক্ ভাব বা নানাত্ব একস্থ অর্থাৎ এক ব্রহ্মবস্তুতেই অবস্থিত এবং সেই ব্রহ্ম হইতেই এই নানাত্বের বিস্তার দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন । ৩০
হে কৌন্তেয়, অনাদি ও নির্গুণ বলিয়া এই পরমাত্মা অবিকারী; অতএব দেহে থাকিয়াও তিনি কিছুই করেন না এবং কর্মফলে লিপ্ত হন না । ৩১
যেমন আকাশ সর্ববস্তুতে অবস্থিত থাকিলেও অতি সূক্ষ্মতা হেতু কোন বস্তুতে লিপ্ত হয় না, সেরূপ আত্মা সর্বদেহে অবস্থিত থাকিলেও কিছুতেই লিপ্ত হন না । ৩২
হে ভারত, যেমন এক সূর্য সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করেন, সেরূপ এক ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা) সমস্ত ক্ষেত্র বা দেহকে প্রকাশিত করেন । ৩৩
যাহারা জ্ঞানচক্ষুদ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভেদ এবং ভূতপ্রকৃতি অর্থাৎ অবিদ্যা হইতে মোক্ষ কি প্রকার তাহা দর্শন করেন (জানিতে পারেন) তাহারা পরমপদ প্রাপ্ত হন । ৩৪
মন্তব্যসমূহ