শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু : চরিতামৃত

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু : চরিতামৃত
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু :

জীবের ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু। দ্বাপর যুগের কৃষ্ণ ও বলরাম কলিযুগে পুনরায় এসেছেন । শ্রীকৃষ্ণ হয়েছে । শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য বা শ্রী গৌরসুন্দর ; আর বলরাম হয়েছেন প্রভু নিত্যানন্দ । দ্বাপরে যিনি আপন শােভা সৌন্দর্য , রূপ মাধুর্য , লীলা মাধুর্য দিয়ে সর্বজীবকে আকর্ষণ করেছিলেন , তিনিই শ্রীকৃষ্ণ । আর কলিযুগে যিনি কৃষ্ণকথা , কৃষ্ণনাম , কৃষ্ণলীলার মাধুর্য শুনিয়ে এবং আস্বাদন করিয়ে জীবের সুপ্ত চৈতন্যকে উদীপ্ত করেছেন , তিনিই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু বা শ্রী গৌরসুন্দর ।

১৪৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ফান্ধুনী পূর্ণিমা তিথিতে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্যগ্রহণ করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু । মাতার নিবাস বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার ঢাকা দক্ষিণ । বাল্যনাম নিমাই । সােনার বরণ দেহ দেখে পাড়ার লােকেরা নাম রাখেন গৌরাঙ্গ । ভক্তের কাছে তিনি নবদ্বীপচন্দ্র , মহাপ্রভু । শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর আবির্ভাবের সময়ে সমাজে হিংসা বিদ্বেষ প্রবল হয়েছিল । জাতিভেদের কুসংস্কারে সমাজ জীবন ছিলাে আচ্ছন্ন । হৃদয়বান মানুষের ছিলাে । চরম অভাব , হিন্দুধর্মের মর্মবাণী বিভ্রান্তির জালে ছিলাে আবদ্ধ । তাই নামপ্রেম দিয়ে জগতে মঙ্গল সাধন করতেব্রজলীলার তিনটি অপূর্ণ সাধ পূরণের লক্ষ্যেই তিনি আবির্ভূত হন । ভক্তের ভালবাসা কেমন , ভগবানের মাধুর্য কেমন এবং ভগবানকে ভালবেসে ভক্তের কি কি আনন্দ , সেটা আস্বাদনের জন্যই ভগবান নদীয়ায় ভক্তের বেশে এসেছিলেন।

বিধবা মা শচীদেবী দূরন্ত নিমাইকে পড়তে দিয়েছিলেন গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে । অসাধারণ স্মৃতি ও প্রতিভার অধিকারী নিমাই কাশ্মীরের প্রথিতযশা পণ্ডিত কেশব মিশ্রকে হারিয়ে নবদ্বীপে খ্যাতি অর্জন করেন । পরলােকগত পিতার পিণ্ডদান করার ইচ্ছায় গয়াধামে গেলে মহাবৈষ্ণব ঈশ্বরপুরীর নিকট বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে নিমাই এক নতুন মানুষ হয়ে গেলেন । নবদ্বীপে ফিরে এলেন নিমাই , কৃষ্ণ বিরহে কাতর এক নতুন মহাপ্রেমিক , সাধক । শ্রীবাস , গদাধর , মুকুন্দ , হরিদাস প্রমুখ , নিমাইয়ের সাথে মিলিত হয়ে নাম সংকীর্তন করেন । বাংলার বৈষ্ণব প্রধান অদ্বৈত আচার্যের স্বীকৃতি পেলেন , আবিস্কার করলেন প্রধান পার্ষদ শ্রী নিত্যানন্দকে । গৌরের নামের সাথে যুক্ত হলাে “ গৌর - নিতাই " ভক্তমুখে এক অবিচ্ছেদ্য নাম । পাশে টেনে নিলেন পুণ্ডরীক বিদ্যানিধিকে , দরিদ্র শ্রীধরকে , উদ্ধার করলেন জগাই ও মাধাইকে । শুরু হলাে ভক্তির বন্যা , এক গণজাগরণ ।

শ্রীচৈতন্য ভাবলেন , তার প্রেমভক্তির ধর্ম কি করে বিশ্ব মানব কল্যাণে নিয়ােজিত করতে পারেন সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । কাটোয়ার কেশব ভারতীয় নিকট সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হলেন । প্রেমভক্তি প্রচারের লক্ষ্যে পুরী হয়ে দাক্ষিণাত্যে এবং পরে বৃন্দাবনে যান । এই সময় শ্রীরূপ , সনাতন , রঘুনাথ ভট্ট , রঘুনাথ দাস , শ্রীজীব ও গােপাল ভট্ট প্রমুখ পণ্ডিতের সাথে মিলিত হন এদের প্রতিভা ছিলাে অত্যন্ত তীক্ষ্ম , ভক্তি ও বিশ্বাস ছিলাে সুদৃঢ় এবং প্রকাশের ক্ষমতা ছিলাে অবিশ্বাস্য । তাই বৈষ্ণবীয় সাহিত্য ও ভাবধারা চতুর্দশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী অবধি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল ।

কাশীতে প্রকাশনানন্দ স্বামীকে কৃষ্ণ প্রেমে আকৃষ্ট করে হরিনামের ধ্বজা তুলে শ্রীমহাপ্রভু পুনরায় নীলাচলে গমন করেন । জীবনের শেষ ১৮ বছর নীলাচলেই অতিবাহিত করেন । ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে আষাঢ় মাসে একদিন প্রভ দিব্যভাবাবেশে আবিষ্ট হয়ে জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রবেশ করলেন । মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেল । যখন কপাট খুলল , তখন প্রভুকে আর দেখা গেল না । শ্রী গৌরসুন্দর জগন্নাথদেবের বিগ্রহে লীন হয়ে গেলেন ।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নিকটে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ ছিল না । প্রেমভক্তির প্রভাবে উঁচু - নীচুর ভেদবুদ্ধি দূর হয় । মহাপ্রভুর মতে , জীব হচ্ছে “ কৃষ্ণের নিত্যদাস " কৃষ্ণেরই জীবশক্তি । মায়ার প্রভাবে এ সত্য ভুলে গিয়ে জীব সংসার আবদ্ধ হয় , সাধু সজ্জনের কৃপায় জীবের শ্রীকৃষ্ণ ভজনে রুচি হলে মায়া তাকে ছেড়ে যায় । তখন সেই জীব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণ পেয়ে ধন্য হয় । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র