তৃতীয় মণ্ডল: সুক্ত - ২৪

অনুবাদ
১। দেবগণের মধ্যে কোন শ্রেণীর কোন দেবের চারু নাম উচ্চারণ করব? কে আমাকে এ মহতী পৃথিবীতে আবার ছেড়ে দেবেন? (১) যে আমি পিতা ও মাতাকে দর্শন করতে পারি?

২। দেবগণের মধ্যে প্রথম অগ্নিদেবের চারুনাম উচ্চারণ করি; তিনি আমাকে এ মহতী পৃথিবীতে ছেড়ে দিন, যেন আমি পিতাকে ও মাতাকে দর্শন করতে পারি।

৩। হে সদা রক্ষণশীল সবিতা! তুমি বরণীয় ধনের ঈশ্বর, তোমার নিকট সম্ভোগযোগ্য ধন যাচ্ঞা করি।

৪। যে প্রশংসিত, অনিন্দিত, দ্বেষরহিত, ও সম্ভোগযোগ্য ধন তুমি হস্তদ্বয়ের ধারণ করে আছ।

৫। হে সবিতা! তুমি ধনযুক্ত, তোমার বরণে দ্বারা ধনের উৎকর্ষ লাভ করতে ব্যাপৃত থাকি।

৬। হে বরুণ! এ উড্ডীয়মান পক্ষিগণ তোমার ন্যায় বল, তোমার ন্যায় পরাক্রম, তোমার ন্যায় ক্রোধ প্রাপ্ত হয়নি; এ অনিমিষ-বিচারী জল ও বায়ুর গতি তোমার বেগ অতিক্রম করে না।

৭। বিশুদ্ধবল রাজা বরুণ মুলরহিত অন্তরীক্ষ থেকে বর্ণনীয় তেজ:পূঞ্জ ঊর্ধে ধারণ করেন; সে রশ্মিপূঞ্জ অধোমুখ, কিন্তু তাদের মুল ঊর্ধ্বে তদ্বারা যেন আমাদের মধ্যে প্রাণ নিহিত থাকে।

৮। রাজা বরুণ সূর্যের ক্রমান্বয়ে গমনার্থে পথ বিস্তীর্ণ করেছেন; পদরহিত অন্তরীক্ষে সুর্যের পদবিক্ষেপের জন্য পথ করেছেন; তিনি আমার হৃদয়বিদ্ধকারী শত্রুকে তিরস্কার করুন।

৯। হে বরুণরাজ! তোমার শত ও সহস্র ঔষধি আছে, তোমার সুমতি বিস্তীর্ণ ও গভীর হোক; নিঋরইতকে (২) পরাম্মুখ করে রাখ, আমাদের কৃত পাপ হতে আমাদের মুক্ত কর।

১০। ঐ যে সপ্তর্ষি নক্ষত্র (৩) যা উচ্চে স্থাপিত আছে এবং রাতে দৃষ্ট হয়, দিনে কোথায় চলে যায়? বরুণের সর্মসমূহ অপ্রতিহত, তাঁর আজ্ঞায় রাত্রে চন্দ্র দীপামান হয়।

১১। আমি স্ত্রোত্র দ্বারা স্তব করে তোমার নিকট সে পরমায়ু যাচ্ঞা করি, যজমান হব্যদ্বারা তাই প্রার্থনা করে। হে বরুণ! তুমি এ বিষয়ে অনাদর না করে মনোযোগ কর, তুমি বহুলোকের স্তুতিভাজন, আমার আয়ু নিও না।

১২। রাতে ও দিনে লোকে আমাকে এই বলেছে, আমার হৃদয়স্থ জ্ঞানও এরূপ প্রকাশ করছে, আবদ্ধ হয়ে শুন:শেপ যে বরুণকে আহ্বান করছে, সে রাজা আমাদের মুক্তি দান করুন।

১৩। শুন:শেপ ধৃত হয়ে ও তিন পদ কাষ্ঠে বন্ধ হয়ে অদিতির পুত্র বরুণকে আহ্বান করেছিল; অতএব বিদ্বান ও অহিংসিত বরুণ তাকে মুক্তি দিন, তার বন্ধন মোচনকরে দিন।

১৪। বরুণ নমস্কার করে তোমার ক্রোধ অপনয়ন করি, যজ্ঞের হব্যদান করে তোমার ক্রাধ অপনয়ন করি। হে অসুব (৪)! হে প্রচেত:! হে রাজন! আমাদের কৃত পাপ শিথিল কর।

১৫। হে বরুণ! আমার উপরের পাশ উপর দিয়ে খুলে দাও, আমার নীচের পাশ নীচে দিয়ে খুলে দাও, মধ্যের পাশ খুলে শিথিল করে দাও। তৎপরে হে অদিতিপুত্র! আমরা তোমার রত খন্ডন না করে পাপরহিত হয়ে থাকব।

টীকা
১। শুন:শেপকে বলি দেবার কথা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, রামায়ণ ও পুরাণাদি অনেক গ্রন্থে পাওয়া যায়। কিন্তু ঋগ্বেদে শুন:শেপকে বলি দেবে এরূপ কথা কি স্পষ্ট করে লেখা আছে? নরবলি প্রথা কি প্রচলিত ছিল? ঋগ্বেদের অন্য কোনও স্থানে নরবলির স্পষ্ট উল্লেখ নেই, শুন:শেপের এ চতুবিংশ সুক্তেও তাকেঁ বলি দেবার স্পষ্ট কোন কথা নেই। অতএব পন্ডিতবর রোসেন বিবেচনা করেন নরবলি ছিল না। পন্ডিতাগ্রহন্যরাজেন্দ্রলাল মিত্র বিবেচনাকরেন নরবলি প্রথা প্রচলিত ছিল। ঋগ্বেদের সময় নরবলি প্রথা ছিল আমাদের বোধ হয় না, কেন না যে গ্রন্থে সোম অভিষবের ও ঘৃত অভিষবের কথা শত বার বলা হয়েছে, নরবলি প্রথা সে সময়ে প্রচলিত থাকলে সে গ্রন্থে তার বিশেষ উল্লেখ নেই কেন?

২। মুলে নিঋতিং াছে। অস্মদনিষ্টকারিণীং নিঋতিং পাপদেবতাং। সায়ণ। ঋত অর্থ নিয়ম বা সত্য বা যজ্ঞ। নিঋরইত অর্থে অনিয়ম বা অসত্য বা পাপ। তা হতে পাপ দেবীর নাম নিঋরইত হল।


৩। ঋক্ষাঃ মূলে আছে। ঋক্ষাঃ সপ্ত ঋষয়ঃ! যদ্বা ঋক্ষাঃ সর্বেহপি নক্ষত্র বিশেষাঃ সায়ণ। সপ্তর্ষি নক্ষত্রকে ঋক (ভল্লুক) এবং ইউরোপীয় ভাষায় বলে কেন? এর একটি অতি রহস্যজনক কারণ আছে। ঋচ বা অর্চ ধাতুর অর্থ উজ্জ্বল হওয়া বা অর্চন করা। উজ্জ্বল হওয়া অর্থে এ ধাতু হতে উজ্জ্বল লোমধারী ভাল্লুকের নাম ঋক্ষ হয়। কালক্রমে লোকে ঋক শব্দের নক্ষত্র অর্থটি ভুলে গেল, এবং যে সপ্তর্ষি নক্ষত্রকে কক্ষ বলত, তার অর্থ ভল্লুক নক্ষত্র করল। ৪। অস ধাতু অর্থ ক্ষেপণ, অতএব, সায়ণ অসুর অর্থ অনিষ্ট ক্ষেপণশীল করেছেন। কিন্তু বরুণকে অসুর বলবার এ অপেক্ষা গুঢ় কারণ আছে। আদিম আর্যগণ উপাস্যদেবকে অসুর বা দেব বলতেন। পরে সে আর্যদের মধ্যে একটি বিবাদ ও বিচ্ছেদ হয়ে দুটি দল হল এবং এক দলের রোক অন্য দলের উপাস্যদের নিন্দা করতে লাগল। সে দুই দলের এক দল ভারতবর্ষে এলেন, তাঁরা প্রাচীন হিন্দুর অন্য দলে প্রাচীন ইরানীয়। ইরানীয়গণ উপাস্যদেব সাধারণ নাম অসুর দিলেন এবং হিন্দুদের উপাস্য দেবগণকে নিন্দা করতে লাগলেন। এবং হিন্দুগণ উপাস্যদের নাম দেব দিলেন এবং ইরানীয়দের উপাস্য অসুরদের নিন্দা করতে লাগলেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র