পঞ্চম মণ্ডল: সুক্ত - ৫২

অনুবাদ

১। শত স্তোতা একেবারে যার স্তুতি কার্যে প্রবৃত্ত হয়, যিনি স্বর্গ জানিয়ে দেন, সে মেষ ইন্দ্রকে সম্যকরূপে পূজা কর। তার রথ গমনশীল অম্বের ন্যায় বেগে যজ্ঞের দিকে গমন করে, আমি রক্ষার হেতু ইন্দ্রকে সে রথে উঠবার জন্য অনেক স্তুতি দ্বারা অনুরোধ করছি।

২। যখন যজ্ঞান্নপ্রিয় ইন্দ্র জল বর্ণষ করে নদী প্রতিরোধকারী বৃত্রকে হত করলেন, তখন তিনি ধারাবাহী জলের মধ্যে পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে লোকদের সহস্ররূপে রক্ষা করে প্রভূত বলপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

৩। তিনি আবরণকারী শত্রুদের জয় করেন, তিনি জলবৎ অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত আছেন, তিনি সকলের আহলাদের মূল এবং সোমপানে বর্ধিত হয়েছেন; আমি মনীষী ঋত্বিকদের সাথে সে প্রবৃদ্ধ ধনসম্পন্ন ইন্দ্রকে শোভন কর্মযোগ্য অন্ত:করণের সাথে আহ্বান করছি, কেননা তিনি অন্ন পূরণ করেন।

৪। সমুদ্রের আত্মীয়ভূত ও অভিমুখগামী নদীসমূহ যেরূপ সমুদ্রকে পূরণ করে, সেরূপ কুশস্থিত সোমরস দিব্যলোকে ইন্দ্রকে পূরণ করে; শত্রুশোষণকারী ও অপ্রতিহত ও শোভনরূপ মরুৎগণ বৃত্রহনন সময়ে সে ইন্দ্রের সহায় হয়ে নিকটে উপস্থিত ছিলেন।

৫। গমনশীল জল যেরূপ নিন্মদেশে যায়, ইন্দ্রের সহজায়ভূত মরুৎগণ হৃষ্ট হয়ে সেরূপ যুদ্ধে লিপ্ত ইন্দ্রের সম্মুখে বৃষ্টিযুক্ত বৃত্রের অভিমুখে গেলেন। ত্রিত (১) যেরূপ পরিধি সমুদয় ভেদ করেছিলেন, ইন্দ্র সেরূপ যজ্ঞের অন্ন দ্বারা প্রোৎসাহিত হয়ে বলকে ভেদ করেন।

৬। জল রুদ্ধ করে যে বৃত্র অন্তরীক্ষের উপরিপ্রদেশে শয়ান ছিল এবং অন্তরীক্ষে যার ব্যাপ্তি অসীম, হে ইন্দ্র! যখন তুমি সে বৃত্রের হনুদ্বয় শব্দায়মান বজ্র দ্বারা আঘাত করেছিলে তখন তোমর শত্রু বিজয়িনী দীপ্তি বিস্তৃত হয়েছিল এবং তোমার বল প্রদীপ্ত হয়েছিল।

৭। ঊর্মি সমূহ যেরূপ হ্রদপ্রাপ্ত হয় সেরূপ যে স্তোত্রসমূহ তোমাকে বর্ধন করে সে সমস্ত তোমাকে প্রাপ্ত হয়। ত্বষ্টা তোমার যোগ্য বল বৃদ্ধি করেছেন এবং তার পরাভবকারী বল দ্বারা বজ্র তক্ষ্মি করেছেন।
৮। হে সিদ্ধকর্মা ইন্দ্র! তুমি অশ্বযুক্ত হয়ে মানুষের নিকট অগমনার্থ বৃত্তকে হত করেছ, বৃষ্টিবর্ষণ করেছ, হসতদ্বয়েলৌহ বজ্র গ্রহণ করেছ, এবং আমাদের দর্শ নার্থ কআকাশে সূর্য স্থাপন করেছ।

৯। স্তোতৃগণ বৃত্রের ভয়ে স্ত্রোত্র রচনা করেছে, সে স্ত্রোত্র বৃহৎ আহ্লাদজনক, বলযুক্ত এবং স্বর্গের সোমপান স্বরূপ; তখন স্বর্গরক্ষক মরুৎগণ মানুষের জন্য যুদ্ধ করে এবং মানুষগণকে পালন করে ইন্দ্রকে প্রোৎসাহিত করেছিলেন।

১০। হে ইন্দ্র! তুমি অভিষুত সোমপান করে হৃষ্ট হলে যখন তোমার বজ্র দ্যু ও পৃথিবীর বাধনকারী বৃত্রের মসতক বেগে ছিন্ন করেছিল, তখন বলবান আকাশও সে অহির শব্দে ভয়ে কম্পিত হয়েছিল।

১১। যদি পৃথিবী দশগুণ হত, যদি মানুষ সকল নিত্য কাল জীবিত থাকত, হে মঘবন! তা হলেই তোমার ক্ষমতা প্রকৃত রূপে প্রসিদ্ধ হত; তোমার বলসাধিত ক্রিয়া আকাশের ন্যায় মহৎ।

১২। হে শত্রু বিনাশক ইন্দ্র! এই ব্যাপ্ত অন্তরীক্ষের উপরে থেকে তুমি নিজ ভুজ বলে আমাদের রক্ষার জন্য ভূলোক সৃষ্টি করেছ; তুমি বলের পরিমাণ স্বরূপ; তুমি সুগন্তব্য অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ ব্যাপ্ত করে আছ।

১৩। তুমি বিস্তীর্ণ পৃথিবীর পরিমাণ স্বরূপ; তুমি দর্শনীয় দেবগণের বৃহৎ স্বর্গের পালনকারী; তুমি প্রকৃতই নিজ মহত্ত্ত দ্বারা সমস্ত অন্তরীক্ষ ব্যাপ্ত করে আছ; অতএব তোমার সদৃশ অন্য কেউ নেই।

১৪। দ্যু ও পৃথিবী যে ইন্দ্রের ব্যাপ্তি প্রাপ্ত হয় নি, অন্তরীক্ষের উপরস্থ প্রবাহ যার তেজের অন্ত পায়নি, হে ইন্দ্র! তুমি একা অন্য সমস্ত ভূতজাতকে তোমার অধীন করেছ।


১৫। মরুৎগণ এ সংগ্রামে তোমাকে অর্চনা করেছিলেন; যখন তুমি অশ্রিযুক্ত বজ্র দ্বারা বৃত্রের মুখের উপর আঘাত করেছিলে, তখন সকল দেবগণ যুদ্ধে তোমাকে আনন্দিত দেখে আনন্দিত হয়েছিলেন।

টীকা
১। সায়ণ তৈত্তিরীয় সংহিতা অনুসারে ত্রিত সম্বন্ধে এরূপ লিখেছেন, দেবগণের হব্যের চিহ্ন বিমোচনার্থ অগ্নি জল হতে একত, দ্বিত, ও ত্রিত নামে তিন জন পুরুষ সৃষ্টি করেন। ** ত্রিত উদক পানে প্রবৃত্ত হয়ে কূপে পড়েছিলেন, অসুরেরা তাকে প্রতিরোধ করবার জন্য পরিধি অর্থাৎ কূপের আচ্ছাদন সৃষ্টি করল, ত্রিত তা ভেদ কারছিলেন। ইন্দ্র যেরূপ অহি বা বৃত্তের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, ত্রৈতন বা ত্রিতত্ত সেরূপ করেছিলেন, তা ঋগ্বেদের স্থানে স্থানে পাওয়া যায়। ত্রিত বা ত্রৈতন যে আর্যদের অতি পুরাতন দেব তা ইরানীয় অবস্থায় দেখা যায়। ঋগ্বেদে অহিহস্তা ইন্দ্র যেরূপ উপাস্য অবস্থায় অজি হস্তা থেতন সেরূপ উপাস্য। ঋগ্বেদের ত্রিত আপ্তা বংশীয় (১০৫ সুক্তের ৯ ঋক দেখুন) অবস্থার থতন ও আথা বংশীয়। আবার ইরানীয়দের জেন্দ অবস্থা রচনার প্রায় দু হাজার বছর পর এ ত্রৈত্যনর গল্প ইরানীয়দের ইতিহাসে প্রবেশ করল। পারস্যদের প্রধান কবি ফেরদৌসী নিজ শাহনামা নামক কাব্যে লিখেছেন যে জোহক নামে পারস্যদেশের ত্রিমস্তক সম্পন্ন রাজ্য ছিলেন এবং পফরুদীন তাকে বিজয় করেন। এ জোহক জেন্দ অবস্থায় অজি দহক এবং বেদের অহি এবং এই ফেরুদীন জেন্দ অবস্থার থ্রেতন এবং বেদের ত্রতন। উপাখ্যানের উৎপত্তি কি বিস্ময়কর! গ্রীকদের ধর্মোপাখ্যানে ও প্রাচীন আর্য ত্রিত দেবের পরিচয় পাওয়া যায় গ্রীকদের প্রধান দেব Zeus এবং তার কন্যা Athene (সংস্কৃত অহনা) কখন কখন ত্রিত কন্যা (Tritogeneia) নামে বর্ণিত হতেন। অতএব প্রতীয়মান হচ্ছে যে আপ্তাবংশীয় অহি হস্তা ত্রিত বা ত্রৈতন আর্যদের অতি প্রাচীন উপাস্য দেব ছিলেন, পরে হিন্দুগণ যখন ইন্দ্রকেই অহিহন্তা বলে অধিক উপাসনা করতে লাগলেন, তখন ত্রিত কেবল একজন বীর মানুষ বলে পরিগণিত হলেন। ১০৬ সুক্তের ৬ ঋকের টীকা এবং ১৫৮ সুক্তের ৫ ঋকের টীকা দেখুন।

পঞ্চম মণ্ডল- ঋগ্বেদ সংহিতা

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র