ভগবান কৃষ্ণ এবং ভগবদগীতাঃ মূল শ্লোকসমূহ ।

ভগবান কৃষ্ণ এবং ভগবদগীতাঃ মূল শ্লোকসমূহ । 

মূকং করােতি বাচালং , পঙ্গুং লংঘয়তে গিরিম্ 
যৎ কৃপা তমহং বন্দে , পরমানন্দ মাধবম্ । 

অর্থ- আমি ভগবান কৃষ্ণকে প্রণাম করি , যার কৃপায় মূক বাচাল হয় , পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করতে পারে । ঈশ্বরের কৃপা বর্ষণ হলে , কৃষ্ণময় জীবন আনন্দ ভূমিতে পরিণত হয় । 

ভগবান কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল মথুরায় ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে । তার পিতার নাম বাসুদেব ও মাতার নাম দেবকী । মথুরার রাজা ছিলেন কংস নামে এক নরপতি । তিনি ছিলেন সম্পর্কে দেবকীর ভাই অর্থাৎ কৃষ্ণের মাতুল । কংস দুবৃত্ত , অত্যাচারী ছিলেন , তার অত্যাচার থেকে কেউ নিস্তার পেতনা , এমনকি মুনি - ঋষিদেরও তিনি অব্যাহতি দিতেন না । কংস তার পিতা উগ্রসেনকে কারারুদ্ধ করে মথুরার রাজমুকুট তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন । 

এক দৈবজ্ঞ কংসকে বলেন , “ তােমার ভগ্নী দেবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্রের হাতে তুমি নিহত হবে । তাই দেবকীর বিবাহের পরেই রাজা কংস দেবকী ও বাসুদেবকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন । প্রত্যেক বার দেবকীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই কংস নিজে এসে শিশুটিকে হত্যা করতেন । 

দেবকী অষ্টমবার গর্ভবতী হলেন । বিষ্ণুর ভগবৎ সত্ত্বা দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে কারাভ্যন্তরে জন্মগ্রহণ করলেন । সেই সন্তান ভগবান কৃষ্ণ ।

কৃষ্ণের জন্মের রাত্রিতে ঝড় উঠল , বজ্রপাত হল , বন্যা দেখা দিল । প্রহরীগণ নিদ্রাভিভূত হলেন এবং অলৌকিকভাবে কারাগারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল । ভগবান কৃষ্ণের জন্ম হওয়ামাত্র বাসুদেব দৈববাণী শুনলেন , “ এই শিশুকে যমুনা পার হয়ে গােকুলে । নিয়ে যাও । শিশুর জন্মের কথা কেউ জানবার আগেই তুমি কারাগারে ফিরে আসবে । ” বাসুদেব কালবিলম্ব না করে শিশুকে কোলে তুলে নিলেন , দেখলেন কারাগারের দ্বার আপনি খুলে গেল , যাতে তিনি বেরিয়ে যেতে পারেন । 

বাসুদেব যমুনার তীরে এসে দেখলেন প্রচণ্ড ঝড় - বৃষ্টিতে নদী উত্তাল । যাই হােক , বাসুদেব নদী তীরে উপনীত হওয়ামাত্র নদী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বাসুদেব , যিনি ভগবৎ - শিশুকে বহন করছেন , তার জন্যে পথ করে দিল । বাসুদেব নিরাপদে নদীর অপর তীরে পৌছােলেন । দেখলেন গােকুলের অধিবাসীরা নিদ্রামগ্ন । 

তিনি গােপালকদের প্রধান নন্দ ও তার মহিষী যশােদার গৃহে প্রবেশ করে শিশু কৃষ্ণকে বন্ধু নন্দের হাতে সমর্পণ করলেন । নন্দ কৃষ্ণকে যশােদার পাশে শুইয়ে দিলেন । যশােদা সেই থেকে হলেন কৃষ্ণের পালিকা মাতা । তিনি শিশু কৃষ্ণকে বড়াে করে তুললেন । 

কৃষ্ণের অর্থ কালাে । ভগবান কৃষ্ণ শ্যামবর্ণ ছিলেন । সেই কারণে কৃষ্ণবর্ণের প্রতি হিন্দুরা বিশেষ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পােষণ করে । 

অত্যাচারী কংস দেবকীর সন্তানের জন্মের কথা শােনামাত্র কারাকক্ষে ছুটে গেলেন নবজাত শিশুকে বধ করবার জন্যে । দেবকীর পুত্রকে বধ করতে না পেরে ক্রোধে অন্ধ হয়ে তিনি বৃন্দাবন এবং তার নিকটবর্তী স্থানের যত শিশু ছিল তাদের সকলকে বধ করার আদেশ দিলেন । কিন্তু সনাতন ধর্মের পুনঃসংস্থাপনের জন্যে যার জন্য তিনি অক্ষত থেকে গেলেন এবং তার পরেও তাকে বধ করার কংসের সমস্ত চেষ্টা তিনি ব্যর্থ করেছিলেন ।

কংস আপসের জন্যে আলােচনা করতে চান , এই ছলনাময় অজুহাতে কৃষ্ণের পিতৃব্য অরকে দিয়ে যুবক কৃষ্ণকে মথুরায় ডেকে পাঠালেন । কৃষ্ণের বয়স তখন মাত্র ১৪ । তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে কংস প্রথমে ভাড়াটে খুনীকে দিয়ে তারপরে এক মত্ত হস্তীকে দিয়ে তাকে বধ করবার চেষ্টা করলেন । শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ দৌড়ে কংসের সিংহাসনের কাছে গেলেন এবং এক হাতাহাতি যুদ্ধে বালক কৃষ্ণের দ্বারা কংস নিহত হলেন । কংসের পিতা উগ্রসেনকে কৃষ্ণ আবার সিংহাসনে বসালেন । এক জঘন্য অত্যাচারীর অত্যাচার শেষ হল । 

ভগবান কৃষ্ণের বাল্যকালে অনেকবার তাকে বধ করার চেষ্টা । হয়েছিল । গােয়ালিনী বালিকাদের মধ্যে তিনি বড়াে হয়ে ওঠেন । বৃন্দাবনে শেষােক্তদের বলত গােপী । বাল্যকালে কৃষ্ণ তার বন্ধুদের শেখাতেন কীভাবে নৃত্য ও গীতকলার মাধ্যমে জীবনীশক্তির বালসুলভ প্রাচুর্যের ব্যবহার করতে হয় - একজন গােপী , বালিকা রাধা তার সর্বাপেক্ষা অনুরক্ত বন্ধু ও শিষ্যা ছিলেন । 

চতুর্দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত নৃত্য , গীত ও বালসুলভ নানা দুষ্টুমিতে তিনি বাল্যকালের আনন্দ উপভােগ করেন এবং বৃন্দাবনের সকলকে আনন্দ সাগরে ভাসিয়ে রাখেন । সেই সব আনন্দময় দিনগুলাের স্মৃতি কাহিনী আজও হিন্দুদের মনকে আনন্দময় করে তােলে । সেই সব মধুর সংগীতময় দিনগুলােকে ভিত্তি করে বিরাট বৈষ্ণব সাহিত্য তৈরী হয়েছে । চৌদ্দ বৎসর বয়সে কৃষ্ণ তাঁর বাল্যের বাসভূমি বৃন্দাবন চিরদিনের জন্যে পরিত্যাগ করে মথুরায় চলে যান । সেখানে দুষ্ট রাজা কংসকে তিনি বধ করেন । 

বাল্যকালেই কষ্ণ ঋষি সন্দীপনীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । গুরুর আশ্রমে তিনি বেদ , গণিত , চিকিৎসা শাস্ত্র এবং যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করেন । 

সারাজীবন বঞ্চিত সাধারণ মানুষদেরকে তাদের প্রাপ্য দেওয়ার জন্যে কৃষ্ণ সংগ্রাম করেছিলেন । সর্বহারাদের জন্যে তিনি নিজের সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য , এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন । বঞ্চিতরা যাতে সুবিচার পায় তার জন্যে তিনি লড়াই করেছিলেন এবং তার জন্যে তাকে পৃথিবীর সেই সময়কার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজনীতিকদের সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছিল । তাঁর লক্ষ্য ছিল সনাতন ধর্মকে একই ছাতার নিচে একটি কেন্দ্রীভূত আন্দোলন করে গড়ে তােলা । পান্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরের পৃষ্ঠপােষকতা তিনি করেছিলেন , এমন ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে , যেখানে দরিদ্রতম যে , সেও যেন সসম্মানে জীবনধারণের সুযােগ পায় । কেন্দ্রীভূত সনাতন ধর্মের মাধ্যমে সে সুবিচার সাধারণ জনতাকে দেওয়া সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করতেন । 

নিজ নিজ অস্তিত্বের রক্ষা ও বর্ধনের জন্য তখনকার হিন্দুরা ছােট ছােট গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের ভগবানের প্রতিভূ বলে প্রচার করতেন এবং নিজেদের ভক্তদের ঠকাতেন । কৃষ্ণকে এর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে । এর জন্যে কৃষ্ণকে নিরন্তর কুৎসা এবং বিপদের মুখােমুখি হতে হয়েছে । 

তার সময়ে আর এক শক্তিশালী অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধ মগধ । শাসন করতেন । কংস ছিলেন জরাসন্ধের জামাতা । কংসের মৃত্যুর প্রতিশােধ নেওয়ার জন্যে জরাসন্ধ ভারতের উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত থেকে বিদেশী এক অশ্বারােহী আক্রমণকারী গােষ্ঠীর নেতা কালযবনকে আমন্ত্রণ জানালেন । নিজের সৈন্যবাহিনী নিয়ে কালবন হিন্দুকুশের এক গিরিবর্ক্স পার হয়ে এসে কৃষ্ণের মথুরা আক্রমণ করলেন । কৃষ্ণ এক দ্বৈরথ সমরে সহজেই কালযবনকে নিহত করলেন । 

জরাসন্ধ কৃষ্ণের অনুগতদের নিপীড়ন , আহত ও হত্যা করে চললেন । সেই দুষ্ট রাজা পুনঃপুন মথুরা অবরােধ করলেন স্ত্রী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এক বৃহৎ সন্যবাহিনী মােতায়েন করে তিনি মথুরায় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন । ভগবান কৃষ্ণ বীরবিক্রমে জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে প্রত্যেক বার পরাস্ত করলেন । 

কষ্ট বুঝতে পারলেন জরাসন্ধের অপরিমেয় ঐশ্বর্য ও সম্পদের তুলনায় তার আর্থিক সামর্থ্য যৎসামান্য । তিনি দেখলেন , জরাসন্ধের সৈনাবাহিনীর ক্ষমতা হাস করতে তার ৩০০ বৎসর ধরে যুদ্ধ করার প্রয়ােজন হবে । জরাসন্ধের সৈন্যবাহিনী ছিল এমনই বিশাল । সেই পরিস্থিতিতে ভগবান কৃষ্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন মথুরার দরিদ্র প্রজাসাধারণের রক্তক্ষয় বন্ধ করবেন । মথুরায় প্রজাসাধারণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভগবান কৃষ্ণ তাঁর সব অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে এক দীর্ঘ যাত্রা আরম্ভ করলেন । তাদের নিয়ে প্রায় এক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিম উপকূলে সমুদ্রতীরে উপনীত হলেন । সেখানে তিনি দ্বারকা নগরী স্থাপন করলেন । 

দ্বারকায় শাসনভার তিনি অর্পণ করলেন তার আত্মীয় বৃফিদের হস্তে । যদিও তিনি স্বয়ং ছিলেন এক বিখ্যাত যােদ্ধা , বিচক্ষণ । রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান কূটনীতিক , তিনি কখনও রাজসিংহাসন নিজের জন্য আকাঙ্খ করেননি । অনেক অত্যাচারী রাজাকে তিনি দমন করেছিলেন বঞ্চিত প্রজারা যাতে সুবিচার পায় , সেই উদ্দেশ্যে । কিন্তু নিজে কখনও বিজিত রাজ্যের সিংহাসন হস্তগত করেননি । প্রজাদের হাতে তিনি সে বিজিত রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন । 

অনেক বৎসর পরে তার বয়স যখন প্রায় ৫৩ , পুরানাে বন্ধুদের ঐকান্তিক অনুরােধে তিনি আবার বৃন্দাবনে ফিরে এলেন এবং থাকলেন প্রায় এক সপ্তাহকাল । বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করার সময় সাধারণ মানুষেরা প্রবল উৎসাহে তাঁর রথের অশ্বগুলােকে মুক্ত করে দিয়ে নিজেরাই সে রথ টেনে নিয়ে গেল । আজ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে হিন্দুরা ভগবান কৃষ্ণের সেই সংক্ষিপ্ত বৃন্দাবনবাসের স্মরণে রথযাত্রা উৎসব পালন করেন । 

ভগবান কৃষ্ণকে সমস্ত জীবন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হত , কিন্তু তিনি সর্বদা শান্ত , নিস্পৃহ থাকতেন । সকলের দুঃখ যন্ত্রণা তিনি নিজের ওপরে গ্রহণ করতেন । সর্বদা নিজের জীবন বিপন্ন করেও দুর্বল ও বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতেন । 

প্রাগ্জ্যোতিষপুরে এক দুষ্ট রাজা ছিলেন । নিজের সেবার জন্যে তিনি ১৬০০ যুবতীকে বন্দী করে রেখেছিলেন । নিজের রাজ্যের প্রজাদের তিনি অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দিতেন । প্রজারা পরিত্রাণের জন্যে কৃষ্ণের শরণ নিলেন । 

ভগবান কৃষ্ণ যুদ্ধ করে প্রাগ্জ্যোতিষপুরের রাজাকে পরাজিত করেন । পরাজিত রাজার পুত্রকে তিনি রাজ্যে প্রত্যর্পণ করেন । ১৬০০ নারী মুক্তি পায় , কিন্তু প্রশ্ন ওঠে , তাদের আহারের ব্যবস্থা কে করবে , তাদের মানসম্ভ্রম কে রক্ষা করবে , তখন কৃষ্ণ এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠান ঘােষণা করলেন যে , সেদিন থেকে ওই ১৬০০ নারীকে কৃষ্ণের স্ত্রী হিসেবে সকলে যেন গণ্য করেন এবং রাজ্যের অধিবাসীরা তাদের ভরণপােষণ , নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন এবং ভগবান কৃষ্ণের স্ত্রী হিসেবে প্রাপ্য সম্মান দেবেন । কেউ তার অন্যথা করলে ভগবান । কৃষ্ণ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন । এই ১৬০০ রমণীদের কারও সঙ্গে কৃষ্ণের কোন রকম দৈহিক সম্পর্ক ছিল না । এই ভাবে এই দুর্ভাগা । ১৬০০ রমণীর ভরণ পােষণ এবং সম্মান রক্ষার ব্যবস্থা ভগবান কৃষ্ণ করেছিলেন । আজ পর্যন্ত যে কোনও হিন্দু নারী বিপদে পড়লে কৃষ্ণকে তার স্বামী , রক্ষাকর্তা বলে মনে করে স্বস্তি বােধ করেন । 

কৃষ্ণ ছিলেন ধরাধামে শ্রেষ্ঠ মানব । তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা দয়ালু , প্রেমময় অত্যন্ত মেধাবী পণ্ডিত , শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও গণিতন্ত এবং অপূর্ব বংশীবাদক । তিনি বলবান , শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ , রাজনীতিক এবং যােদ্ধা হিসেবে অপরাজেয় ছিলেন । 

ভগবান কৃষ্ণ সদা সাধারণ মানুষের একজন ছিলেন , অতি সরল জীবনযাপন করতেন । হিন্দুরা বিশ্বাস করেন কৃষ্ণ ঈশ্বরের নিজের পুত্র । ঈশ্বর তার নিজের পুত্র ভগবান কৃষ্ণকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন , সব রকম যন্ত্রণা ভােগ করবার জন্যে , যাতে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণার লাঘব হয় । 

প্রাসাদে বাস করবার , সুখশয্যায় শয়ন করবার সকল রকম সুযােগ তার ছিল , কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় যে কোনও সাধারণ মানুষের মতো অরণ্যের মধ্যে বৃক্ষতলে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন । ১৪৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি একটি বৃক্ষের তলায় বিশ্রাম করছিলেন । তার গােলাপের মত বর্ণের পদদ্বয় দূর থেকে দেখে একজন শিকারী তাকে একটি লাল পাখী ভ্রম করে একটি বিষাক্ত তীর তার দিকে নিক্ষেপ করে । সেই তীর তার পদদ্বয় বিদ্ধ করে । শিকারী তার ভুল বুঝতে পেরে অতিশয় শােকার্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে চায় । কিন্তু কৃষ্ণ তাকে স্মিত হাসি হেসে আশীর্বাদ করেন । তার অল্পক্ষণ পরেই তিনি পার্থিব জীবন ত্যাগ করেন । তখন তার বয়স প্রায় ৭৫ । 

হাজার হাজার বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও কৃষ্ণের স্মৃতি তার লক্ষ লক্ষ ভক্তের হৃদয়ে আজও সজীব । তার মুরলীর মধুর ধ্বনি তার লক্ষ লক্ষ ভক্তের কর্ণে কোনােদিন নীরব হয়নি । 

নানারূপে কৃষ্ণের পূজা হয় । নারী ও পুরুষের তিনি প্রিয় আদর্শ , শিশুদেরও আদর্শ , বয়স্কদেরও আদর্শ । তিনি একাধারে সর্বাপেক্ষা । উদাসীন সন্ন্যাসী ও সর্বাপেক্ষা অপূর্ব গৃহস্থ রাজার মতাে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও তিনি এক আদর্শ ত্যাগের জীবন যাপন । করতেন , তাঁর দেহত্যাগের অব্যবহিত পরেই ১৪৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমুদ্র গর্ভের ভূ - কম্পজাত এক অতি উচ্চ জলােচ্ছাস দ্বারকাকে এবং আরব সাগরের উপকূলের এক বিরাট অংশকে জলপ্লাবিত করে । হিন্দুধর্মের সর্বশেষ স্বর্গীয় দূত অর্থাৎ দেবতা ছিলেন কৃষ্ণ । 

ভগবান কৃষ্ণ ঈশ্বরের প্রতিভূ , সকলের ত্রাণকর্তা । যারা তাকে ভালােবাসেন তাদের সকলকে তিনি সাফল্য , স্বস্তি ও শান্তি দান । করেন । তিনি দরিদ্র ও দুর্বলকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন । শ্রমজীবী দরিদ্র সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্যে তিনি তার নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছিলেন । রাজমুকুট তিনি কখনও গ্রহণ করেননি । সাধারণ মানুষের পক্ষই তিনি সর্বদা অবলম্বন করেছেন । 

ঈশ্বর তার নিজ সন্তান ভগবান কৃষ্ণকে আমাদের নিকট প্রেরণ করেন । সর্ব প্রকার পার্থিব দুঃখ - যন্ত্রণা ভােগ করতে । তিনি নিজে সে - যন্ত্রণা ভােগ করেছেন , ভালাে মানুষদের যন্ত্রণা যাতে লাঘব হয় , তিনি পাপীদের নির্বাসন দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । 

যে - কেউ নিজেকে কৃষ্ণের নিকট নিবেদন করবেন , তার সকল দুঃখ যন্ত্রণার অবসান হবে , তিনি স্বর্গে গিয়ে ঈশ্বরের পাশে থাকবেন , চিরদিন আনন্দে থাকবেন । ভগবান কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন , তিনি আবার ফিরে আসবেন , ন্যায়পরায়ণ অনুগত জনের দুঃখযন্ত্রণা দূর করবেন । 

তিনি স্বয়ং গীতাতে প্রতিজ্ঞা করেছেন :

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত 
অভূত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ । 
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কতা 
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে । 

ভগবান কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছেন যে যখনই অত্যাচার হবে । লাগাম ছাড়া তিনি আবার জন্মগ্রহণ করবেন অত্যাচারিকে দমন করার জন্য এবং রাজ্যকে অন্যায় ও পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য এবং এমন এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন , যেখানে সকলে সসম্মানে ও সুখে জীবনধারণ করতে পারবেন , ন্যায়বিচার পাবেন । 

গীতা হিন্দুধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের এক ভাণ্ডার অর্থাৎ গীতা হিন্দুজীবনাদর্শের পথ প্রদর্শক । হিন্দুর কাছে গীতা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান শাস্ত্র । অন্য ধর্মেরও কেউ কেউ গীতা পাঠ করে দৈনন্দিন জীবনে তার অনুসরণ করতে পারেন । গীতা মহাভারতের ঐতিহাসিক যুদ্ধের প্রাক্কালে ভগবান কৃষ্ণ কর্তৃক তার শিষ্য অর্জুনকে প্রদত্ত উপদেশাবলির একটি সঙ্কলন । 

মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে । যুদ্ধ হয়েছিল ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নয়া দিল্লির উত্তর - পশ্চিমে প্রায় ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত কুরুক্ষেত্রে । অর্জুন ছিলেন এক বিরাট যােদ্ধা , একজন পাণ্ডব । এইসব উপদেশ যখন তিনি দিচ্ছিলেন তখন কষ ছিলেন এক ধ্যানে । তিনি সেই বিহ্বল আবিষ্ট ধ্যানযােগেই উপদেশ দিয়েছিলেন , অর্জুনের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে । 

গীতার মাধ্যমে ভগবান কৃষ্ণ জীবন যাপনের এবং ঈশ্বর লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ পথ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিলেন । ভগবান কৃষ্ণ । শিক্ষা দিয়েছেন , কর্মযােগ ( কঠিন পরিশ্রমের দ্বারা ফললাভ ) জ্ঞানযােগ ( জ্ঞানের অনুসরণদ্বারা ফললাভ ) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । তিনি বলেন , ঈশ্বর পরম সত্ত্বা , অখণ্ড , অনাদি , অনন্ত , ঈশ্বর সকল কারণের কারণ । তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন , বর্ণভেদ হল প্রত্যেকের ক্ষমতা অনুযায়ী কর্মবিভাগ এবং অর্থনৈতিক কারণে মনুষ্য সৃষ্ট ব্যবস্থা , ঈশ্বর কখনােই তার বিধান দেননি । তিনি বলেন , এ বিশ্বের সবকিছু ঈশ্বরের সৃষ্টি । ঈশ্বর যদি কোনও বস্তুকে অথবা ব্যক্তিকে ঘৃণা করতেন , তিনি নিজে তাকে বিনাশ করতেন । সে কাজের ১১০ হিন্দু ধর্মের শাস্ত্র পরিচয় । জন্যে তিনি তার ভক্তদের ওপর নির্ভর করে নিজের অক্ষমতা প্রমাণ করতেন না । 

গীতা শিক্ষা দেয় , মিথ্যাচারীরা কখনও মােক্ষলাভ করে না । তারা বিপজ্জনক , তাদের সর্বপ্রকারে পরিহার করা উচিত । গীতা আমাদের শিক্ষা দেয় , আমাদের উচিত আমাদের কাজ উত্তমরূপে সমাধা করা , তৎক্ষণাৎ ফললাভের আকাঙ্খা না করা , কারণ ফল । অবস্থা অনুযায়ী এবং কর্মের অনুপাতে আপনি আসবে । 

গীতা বলছেন , সংসার ত্যাগ ( অর্থাৎ সন্ন্যাস গ্রহণ ) সহজতর , ঈশ্বরের নিকট কম প্রতিদায়ক ভগবান কৃষ্ণ তার ভক্তদের সংগ্রাম করতে এবং কর্মযােগের দ্বারা অর্থাৎ কঠোর পরিশ্রম এবং সভাবে বুদ্ধি প্রয়ােগের দ্বারা আনন্দময় জীবনধারণের চেষ্টায় জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে উৎসাহ দিয়েছেন এবং জীবনযুদ্ধে জয়ীরাই ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র । গীতা আরও শিক্ষা দেন , প্রকৃত জ্ঞান মিথ্যার ধুম্রজালে আচ্ছাদিত । এই যুগপােযােগি বাস্তব অবস্থার সম্যক ধারণা প্রয়ােজনীয় । 

মূল গীতায় শ্লোকের সংখ্যা ৭০০ । গীতা ১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত । মূল শ্লোকের কয়েকটি , নিয়মিত যারা পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করেন , তাদের জন্যে এখানে প্রদত্ত হল ।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বিষ্ণু দশ অবতারের পরিচয়

বেদের চনৎকার কিছু শ্লোক।

হিন্দুদের দৈনিক প্রার্থনার মন্ত্র