বেদের বৈশিষ্ট্য কয়েকটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ।
বেদের বৈশিষ্ট্য কয়েকটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচনা করা হলো :
( ১ ) প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ :
বিভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে বৈদিক স্তবস্তুতি ও প্রার্থনা সমূহ প্রাচীনতম ধর্মের ভাণ্ডার । কিছু কিছু বৈদিক কর্মকাণ্ড প্রকৃতিকে আরাধনা করার সাথে সম্পৃক্ত । ঋকবেদের প্রধান দেবতা ছিল মানুষের কল্যাণে নিয়ােজিত প্রকৃতি । অথর্ব বেদ প্রাচীনতম যাদুমন্ত্র ও তান্ত্রিক পদ্ধতির সংগ্রহ সমূহ ।
বৈদিক আর্যগণ প্রণব মন্ত্র , ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ছাড়াও ইন্দ্র , অগ্নি , সােম ইত্যাদির উপাসনাকে প্রাধান্য দিতেন । দেবতা অগ্নি , আলাে যা ছাড়া সৃষ্টি সম্ভব নয় , তার উদ্দেশ্যেই দুই শতাধিক স্তব স্তুতি নিবেদিত হয়েছে । আগুনের উদ্দেশ্যে নিবেদনের লক্ষ্য হচ্ছে অশুভ প্রভাবকে দূরীকরণ । অগ্নি যাত্রাকে সুগম করে , দেহকে উত্তপ্ত করে এবং দৃষ্টিশক্তিকে প্রখর করে । ইন্দ্র ঋগ্বেদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেবতাদের রাজা । প্রাথমিকভাবে তাকে সৃষ্টির দেবতা বলেই মনে করা হয় । ঋগ্বেদের প্রায় এক চতুর্থাংশ স্তবস্তুতি ইন্দ্রের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত । সােমদেবতার উদ্দেশ্যে একশত চৌদ্দটি স্তবকীর্তন ঋগ্বেদে স্থান পেয়েছে । সােমরসকে শক্তি ও বীর্যের দেবতা হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছে । প্রায় সকল আদিম মানুষই সােমরস পানে অভ্যস্ত ছিলাে ।
( ২ ) আচারগত দৃষ্টিকোণ :
আচারগত দিকটিই হিন্দুধর্মের বাস্তব বৈশিষ্ট্য । বৈদিক আচরণের মূল । লক্ষ্য প্রার্থনা ও উৎসর্গের দ্বারা ঐশ্বরিক শক্তির অনুকম্পা লাভ করা যাতে পূজারী বা ভক্তের ইচ্ছা পূরণ হয় । ঋগ্বেদ সংহিতায় অনেক স্তব আছে যার মূল লক্ষ্য প্রতিপক্ষকে পরাভূত করা , কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি , বশীকরণ বিদ্যায় জ্ঞান লাভ , যাদুবিদ্যা অর্জন , জীবের নিরাপত্তা লাভ ইত্যাদি । অথর্ববেদ সংহিতায় বিবাহের মন্ত্র , মৃতব্যক্তির সকার সম্পর্কিত শ্লোক , বিভিন্ন উৎসর্গের স্তোত্র ইত্যাদি স্থান পেয়েছে । সামবেদ এবং যর্জুবেদ সংহিতাকে পুরােহিত দর্পণ বা সংহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে ।
( ৩ ) অদ্বৈতবাদী দৃষ্টিকোণ :
বেদে ঈশ্বর সম্পর্কে যে চিন্তাধারা তা হচ্ছে মূলতঃ বহু - ঈশ্বরবাদ থেকে উত্তরণের মাধ্যমে একেশ্বরবাদ এবং অদ্বৈতবাদে উপনীত হওয়া । রাজা । রামমোহন রায় এর মতে বৈদিক দেবতাগণ এক ঈশ্বরের ব্যাপক হিসেবে রচিত । বৈদিক মন্ত্রে উল্লেখিত দেবীসমূহ এক ঈশ্বরের বিবিধ রূপ , যা মূলতঃ এমতবাদ । বৈদিক দর্শন একেশ্বরবাদ এর মধ্যে সীমিত নয় , পরােক্ষভাবে অদ্বৈতবাদের দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে । বৈদিক স্তোত্র - পরােক্ষভাবে এক ঈশ্বরের গান গেয়ে থাকে ।
( ৪ ) আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ :
বেদের বিশ্বাসকে অন্ধবিশ্বাস বলে ধারণা করার কোন কারণ নেই । বৈদিক ধর্ম বা বেদবাদকে মনে করা হয় একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মব্যবস্থা হিসেবে , সুসামঞ্জস্য প্রথা , আচার ও পূজাপার্বণসহ ধর্মীয় বিশ্বাস সমূহের এক সমাহার রূপে । ঋষি অরবিন্দের মতে বেদবাদ অতীন্দ্রিয় দর্শন এবং উন্নত উপদেশাবলির দ্বারা সমৃদ্ধ । তার মতে বৈদিক দেবদেবীগণ মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার নিদর্শন মাত্র । উদাহরণ স্বরূপ , সূর্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞা , আগুন তেজ - বীর্য ও প্রবল ইচ্ছা এবং সােমরস বিশেষ অনুভূতির রূপমাত্র । বেদের জ্ঞানকাণ্ড আধ্যাত্মিক মূল্যবােধকে তুলে ধরেছে ।
( ৫ ) নৈতিক দৃষ্টিকোণ :
ঋগ্বেদে “ রীতি ” অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ন্যায়পরায়ণতার নীতিকে বেদে রীত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । মীমাংসায় একে “ অপূর্বা ” এবং ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে একে ‘ অদৃষ্ট ' রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে । মিত্র ও বরুণ দেবতা শুধু প্রকৃতির নির্দেশই প্রতিপালন করে না , বিশ্বের নৈতিকতাকেও । নিয়ন্ত্রণ করে । বেদের রীত , নৈতিকতার মানদণ্ড সম্পর্কে জ্ঞানদান করে । বেদের শিক্ষা হচ্ছে মানুষের সকল কর্মকাণ্ড ভগবান অবলােকন করে , কিছুই । তাঁর দৃষ্টির অলক্ষ্যে নয় । বেদের নির্দেশনা হচ্ছে ভাল মানুষ তার পথ থেকে বিচ্যুত হয় না , দয়া ও সেবা মানুষের মহৎ গুণাবলি ।
মন্তব্যসমূহ